কৌশানি থেকে চৌকরি-পাতালভুবনেশ্বর, বিরথি, মুন্সিয়ারি ঘুরে এই একই পথে ফেরার সময় বাগেশ্বরে একরাত কাটিয়ে চলেছি আলমোড়ার দিকে। বাগেশ্বর থেকে আলমোড়ার দূরত্ব ৭২ কিমি।
কুমায়ুনের পথে | Kumaon Tour way to Almora
আমাদের ঠিক ছিল আলমোড়ার ১৬ কিমি আগে কাপড়াখানে নেমে গাড়িভাড়া করে ১৪ কিমি দূরের বিনসর পাহাড়ে উঠব। নামলামও কাপড়াখানে কিন্তু মাত্র ১৪ কিমি রাস্তা যেতে অনেক বেশি গাড়িভাড়া চাওয়ায় আবার বাস ধরে আলমোড়া যেতে বাধ্য হলাম। বিনসরে একরাত থাকার ইচ্ছে ছিল, তা আর হল না।
আগামীকাল আলমোড়া থেকে বিনসর দেখে আবার আলমোড়া ফিরে যাব। লোয়ার আলমোড়া থেকে আপার আলমোড়ায় যেতে বেশ অনেকটা চড়াই। আপার আলমোড়ায় হোটেলের ছড়াছড়ি।
বহু প্রাচীন এই শৈলশহরটি এখন একটি ব্যস্ত আধুনিক জমজমাট নগরী। ১৫৬০ সালে চাঁদরাজা কল্যাণ সিং আলমোড়াকে পুনরাবিষ্কার করেন। এরপর গোর্খারা দখল নেয়। উনিশ শতকে ব্রিটিশদের অধিকারে আসে আলমোড়া। এখানকার ক্লক টাওয়ারটি ব্রিটিশদের তৈরি। রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ প্রভৃতি মুনিঋষিদের পদধূলিতে ধন্য আলমোড়ার খ্যাতি ভারত জোড়া।
স্মৃতিবিজড়িত আলমোড়া | Almora Sightseeing
রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবিজড়িত টেগোর্স হাউস এবং বিবেকানন্দের বাসস্থান ওকলে হাউস আজও সেই পুণ্যস্মৃতি বহন করছে। এখানেই স্বামীজি ভগিনী নিবেদিতাকে ব্রহ্মচর্যে দীক্ষিত করেন। নৃত্যবিশারদ উদয়শঙ্কর এখানে সিমিতোলার পাইন রিজে ওপেন এয়ার থিয়েটারের সূচনা করে যান।
স্বাস্থ্যকর জলবায়ুর জন্যও আলমোড়ার যথেষ্ট খ্যাতি আছে। আলমোড়ার ক্ষীরের মিষ্টান্ন বিখ্যাত। মিষ্টিতে রামদানার যথেষ্ট ব্যবহার বিশেষভাবে লক্ষ্যনীয়। কুমায়ুন ভ্রমণকালে দিগন্ত বিস্তৃত রামদানার খেত নজর কাড়বেই।
এখন শহরের সব জায়গা থেকে হিমালয়ান-ভিউ পাওয়া যায় না। তুষারশৃঙ্গের বুকে সূর্যাস্তের মনোরম শোভা দেখতে হলে পৌঁছতে হবে 'ব্রাইট এন্ড কর্নারে'। ব্রাইট এন্ড কর্নারের নীচুতে স্বামী তুরীয়ানন্দ প্রতিষ্ঠিত রামকৃষ্ণ মিশন ও আনন্দময়ী মায়ের আশ্রম আছে। রামকৃষ্ণ মিশন যাওয়ার রাস্তায় চোখে পড়বে চাঁদ রাজাদের প্রাচীন দুর্গ যা এখন আদালত হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
এই শৈলশহরটির সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি করেছে অগুনতি মন্দির তাই আলমোড়াকে মন্দিরের শহরও বলা চলে। প্রত্যেকটি মন্দিরের স্থান নির্বাচন অনবদ্য। এখানকার নন্দাদেবীর মন্দির বিখ্যাত। আর আছে বহু প্রাচীন ত্রিপুরাদেবীর মন্দির। এছাড়াও আরও শহরময় ছড়িয়ে আছে-- রঘুনাথ, মহাবীর, উল্কাদেবী, রত্নেশ্বর, ভৈরব, মুরলীমনোহর, বদ্রিশ্বর, ডোলিডান্ডা, আদিত্য ও অনন্তপালদেবের মন্দিরগুচ্ছ। এখান থেকে কাসার দেবীর মন্দিরটি ৭ কিমি দূরে। এই মন্দিরের গহ্বরে বারবার ধ্যানস্থ হয়েছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। হিমালয়ের নৈসর্গিক শোভার জন্য কালীমঠের প্রশস্তি-- এখানেও বিবেকানন্দ তপস্যা করেন।
আলমোড়া থেকে মাত্র ১৮ কিমি দূরে কাতারমল। এখানেই রয়েছে বিখ্যাত সূর্যমন্দির। শুধুমাত্র মাটি আর পাথর দিয়ে এমন মন্দির নির্মাণ সম্ভব তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস হয় না। সর্বোপরি মন্দিরটির শ্রেষ্ঠত্ব এর স্থল মাহাত্ম্য। প্রভাত সূর্যের প্রথম কিরণ এই মন্দিরের চূড়োয় এসে পড়ে। আলমোড়া শহরটি ত্রিশূল পর্বতের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে।
আলমোড়া থেকে বিনসর ৩০ কিমি। ঠিক ন-টার সময় ড্রাইভার দাদা গাড়ি নিয়ে হোটেলের দোরগোড়ায় উপস্থিত। আলমোড়া থেকে ১৫ কিমি দূরে ডিনাপানিতে দেখলাম KMVN-এর ট্যুরিস্ট রেস্ট হাউস আছে।
হিমালয়ান-ভিউ পয়েন্ট
এখান থেকে অনেক কাছ থেকে ঘরে বসেই হিমালয়ান-ভিউ দেখা যায়---- পরপর ত্রিশূল, চৌখাম্বা, নন্দাদেবী রেস্ট-হাউসের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। যাঁরা নির্জনতা পছন্দ করেন তারা ডিনাপানিতেও থাকতে পারেন। কাপড়াখান পার হতেই শুরু হল জঙ্গল-- ক্রমশঃ পাইন, ওক, দেওদার, রডোডেনড্রনের ঘন সন্নিবেশ ভেদ করে সূর্যের আলো প্রবেশ করতে পারে না। তাই স্যাঁতস্যাঁতে ভিজে ভাব। আবার কোথাও রোদ-ছায়ার আঁকিবুকি। বিনসরের উচ্চতা প্রায় ৭,৯০০ ফুট। KMVN-এর বাংলো থেকে ২ কিমি হাঁটাপথে জিরো-পয়েন্টের ওয়াচ-টাওয়ার থেকে কেদারনাথ, ত্রিশূল, চৌখাম্বা, নন্দাকোট, নন্দাঘুন্টি, নন্দাদেবী, পঞ্চচুল্লি আরও ডানদিকে নেপাল পাহাড় সুন্দর দৃশ্যমান।
বিনসরে একরাত থাকতে পারলে প্রত্যেক মুহূর্তে উপভোগ করা যায় এখানকার নির্জন সবুজ সৌন্দর্য্যকে। নির্জনতাই বিনসরের মূল সম্পদ আর হাতের নাগালে তুষারআচ্ছাদিত শি্খররাজি দেখতে দেখতে জঙ্গলের পথে হাঁটা আর নাকে বুনো গন্ধের ঘ্রাণ আস্বাদন। হাঁটতে হাঁটতে বন্যপ্রাণীরও দেখা মিলতে পারে। চলে যাওয়া যায় ৪ কিমি দূরে স্নো-ভিউ-পয়েন্ট কিংবা বিনেশ্বর মহাদেব মন্দির। সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তে হিমালয়ের চূড়োয় রঙের খেলার সঙ্গে বিভিন্ন বর্ণের ফুল, প্রজাপতি, পাখির কলতানে এক বর্ণময় পরিবেশ রচিত হয়।
Way to Jageshwar Dham :
এরপর যজ্ঞেশ্বরের পথ ধরি। আলমোড়া থেকে যজ্ঞেশ্বরের দূরত্ব ৩৪ কিমি। দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের অন্যতম এই যজ্ঞেশ্বর কাত্যুরি রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় তৈরি। পাইন ও দেওদারে ছাওয়া এক মনোরম পরিবেশে ১৬৪ টি মন্দিরের সমাহার যজ্ঞেশ্বর। মূল মন্দিরটি যজ্ঞেশ্বর মহাদেবের। মন্দির চত্ত্বরে রয়েছে আরও বেশ কয়েকটি মাঝারি ও ছোটো মন্দির। প্রত্যেকটা মন্দিরের পাথরের দেওয়ালে খোদাই করা সূক্ষ্ম কারুকার্য। এদের মধ্যে মন্দির প্রাঙ্গণে ঢুকতেই মহামৃত্যুঞ্জয় মন্দিরটি প্রাচীনতম।
এছাড়া শিব, পুষ্টিমাতা, কুবেশ্বর মন্দিরগুলি অন্যতম। নীচ দিয়ে বয়ে চলেছে জটাগঙ্গা নদী। প্রায় ৩ কিমি চড়াই ভেঙে বৃদ্ধ যজ্ঞেশ্বর মন্দির, এখান থেকে দিগন্ত-প্রসারিত হিম-সৌন্দর্য্যের তুলনা মেলা ভার। যজ্ঞেশ্বর যেতে ১ কিমি আগে নিরিবিলিতে বাগিচায় সুশোভিত দন্তেশ্বর শিব মন্দিরটিও আর এক দ্রষ্টব্য।আলমোড়ায় ঢোকার মুখে চিতহিদেবী-গোলুদেবতা মন্দির আর লখুটিয়র নামক স্থানে প্রাগৈতিহাসিক গুহাচিত্র দর্শন করে সাঙ্গ হয় আজকের ভ্রমণ।
এরপর নৈনিতালে দুদিন কাটিয়ে কাঠগোদাম থেকে ট্রেন ধরে বাড়ি ফেরার পালা।
কিভাবে যাবেন | How to visit Almora ,Binsar and Jageshwar in Kumaon , Uttarakhand
হাওড়া-লালকুঁয়া সুপার ফার্স্ট এক্সপ্রেসে (সাপ্তাহিক) লালকুঁয়া স্টেশন অথবা হাওড়া-কাঠগোদাম বাগ-এক্সপ্রেসে কাঠগোদাম বা হলদোয়ানি স্টেশন। কাঠগোদামের ৫ কিমি আগে হলদোয়ানি, এখান থেকে বাস/শেয়ার জিপ পেতে বেশি সুবিধা হয়। অন্যপথে যে কোন ট্রেনে লক্ষ্ণৌ পৌঁছে, লক্ষ্ণৌ থেকে ২ কিমি দূরে আইসবাগ স্টেশন। আইসবাগ থেকে মিটারগেজ শাখায় আইসবাগ-লালকুঁয়া-নৈনিতাল এক্সপ্রেসে পরদিন সকালে লালকুঁয়া। লালকুঁয়া থেকে কাঠগোদামের দূরত্ব ২২ কিমি, হলদোয়ানির দূরত্ব ২৭ কিমি। লালকুঁয়া/কাঠগোদাম/হলদোয়ানি যে কোনো স্টেশন থেকে বাস, শেয়ার জিপ, ভাড়া গাড়িতে আলমোড়া।
কখন যাবেন | Best time to visit Almora ,Binsar and Jageshwar in Kumaon , Uttarakhand
সারা বছর যাওয়া যায়।
কোথায় থাকবেন | Lodge/hotels Almora ,Binsar and Jageshwar
আলমোড়া, বিনসর, যজ্ঞেশ্বরে কুমায়ুন মন্ডল বিকাশ নিগম (KMVN) এর লজ আছে। এছাড়া আলমোড়াতে অনেক বেসরকারি হোটেল আছে। বিনসরেও বেসরকারি রিসোর্ট আছে।
প্রয়োজনীয় দূরত্ব | Distance Between
- হলদোয়ানি থেকে আলমোড়া ৯৫ কিমি | Haldwani to Almora 95 k.m.
- আলমোড়া থেকে বিনসর ৩০ কিমি | Almora to Binsar 30 k.m.
- আলমোড়া থেকে যজ্ঞেশ্বর ৩৪ কিমি | Almora to Jageshwar 34 k.m.
- আলমোড়া থেকে নৈনিতাল ৬৩ কিমি | Almora to Nainital 63 k.m.