দার্জিলিং আমার সবসময়ই খুব প্রিয়। তা সে ভিড়, ঘিঞ্জি যাই হোক। দার্জিলিংয়ের একটা আলাদা আকর্ষণ আছে । আমি কখনো দার্জিলিংয়ের সঙ্গে লেপচাজগৎ-এর তুলনা করতে পারিনা। আবার তেমনি তিনচুলে-তাকদা-লামাহাট্টার দিকটাও সম্পূর্ণ অন্যরকম সুন্দর লাগে। শহরের সৌন্দর্য্য একরকম আবার গ্রাম্য সৌন্দর্য্য অন্যরকম।
আরও পড়ুন: খুরীর বালিয়াড়ি এক অচেনা অদেখা রাজস্থান
অফবিট ডেস্টিনেশন লামাহাট্টা | Lamahatta , Darjeeling
দার্জিলিংয়ে দুদিন কাটিয়ে চলেছি লামাহাট্টা হয়ে তিনচুলে। নিউ জলপাইগুড়ি থেকে দার্জিলিং শেয়ার জিপে এলেও, দার্জিলিং থেকে তিনচুলে পৌঁছে দেওয়ার জন্য একটা গাড়ি ভাড়া করে নিয়েছি। কারণ, আমরা লামাহাট্টায় কিছুক্ষণ কাটিয়ে তিনচুলেতে গিয়ে দুদিন থাকবো।
দার্জিলিং না গেলে সরাসরি নিউ-জলপাইগুড়ি/শিলিগুড়ি থেকে বা লেপচাজগৎ ঘুরেও তিনচুলে চলে আসা যায়। দার্জিলিং থেকে ঘুম হয়ে লামাহাট্টার দূরত্ব ২৩ কিমি, উচ্চতা ৫,৭০০ ফুট। লামাহাট্টাতে দু-একটি হোমস্টে আছে, ইচ্ছে হলে এখানেও থাকা যায়। আমাদের লামাহাট্টায় থাকার কোন পরিকল্পনা নেই। লামাহাট্টার প্রধান আকর্ষণ পাইন ও ধুপী গাছে ঘেরা লামাহাট্টা ইকো পার্ক।
বেশ অনেকটা জায়গা জুড়ে প্রকৃতির কোলে তৈরি হয়েছে পার্কটি। মেঘমুক্ত পরিস্কার আকাশে এখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘাও দেখতে পাওয়া যায়। কাঠের তৈরি একটি নজরমিনার আর নানা বাহারি ফুলগাছ পার্কটির শোভা আরো বাড়িয়ে তুলেছে। যতদূর চোখ যায় শুধু সবুজে সবুজ।
পার্ক জুড়ে রঙিন পবিত্র পতাকা উড়ছে। পার্কের মধ্যে দিয়েই ১ কিমি চড়াই পথে পৌঁছে যাওয়া যায় পোখরি, সবুজে ঘেরা ছোট জলাশয়। বনপথে এই হাঁটা পথটুকু বড়োই মনোরম। পথে বসারও জায়গা আছে। লামহাট্টায় প্রায় দু-তিন ঘণ্টা কাটিয়ে, পার্কের উল্টোদিকের দোকান থেকে মোমো খেয়ে রওনা দিই তিনচুলের দিকে।
অফবিট ডেস্টিনেশন তিনচুলে | Tinchuley Offbeat Darjeeling
লামাহাট্টার পর সরু, প্যাঁচানো রাস্তা চলে গেছে পেশক চা বাগানের মধ্যে দিয়ে। ঘন্টাখানেকের পথ। পেশক থেকে তিনচুলে ৫ কিমি। সরু রাস্তা বলে গাড়ি খুব ধীরে ধীরে চলেছে, এতে পথের সবুজ সৌন্দর্য্য আরো ভালো করে উপভোগ করা যাচ্ছে।
তিনচুলে View Point
পৌঁছে গেলাম তিনচুলের গুম্বাদাঁড়া ভিউপয়েন্ট। এখান থেকে সূর্যোদয় সূর্যাস্তের দৃশ্য অপূর্ব, সামনেই খাদের ওপারে সিকিমের নামচি, তারওপারে সপার্ষদ কাঞ্চনজঙ্ঘা। গুম্বাদাঁড়ার পর হালকা আরণ্যক পথ পেরিয়ে তিনচুলের জনবসতি। লোকজন, দোকানপাট এখানে খুবই কম।
১৯৯৬ সালে বিশ্ববন্যপ্রাণী সংস্থা (WWF) এবং হেল্প ট্যুরিজমের সহায়তায় তিনচুলের ১৭টি পরিবার নিয়ে শুরু হয় পর্যটন প্রকল্প বা ইকো-ভিলেজ ট্যুরিজম। এরপর থেকেই তিনচুলে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এতদিনে তিনচুলেতে বেশ অনেকগুলি হোমস্টে হয়ে গেছে।
তিনচুলে আর লামাহাট্টার উচ্চতা প্রায় একই। তিনচুলের অর্থ তিনটি চুলা বা চুল্লি। তিনচুলেকে ঘিরে তিনটি চুলার মতো পাহাড় আগে ভালোভাবে বোঝা যেত। পাহাড়ের মাথায় রোদের আলো পড়লে অনেকটা জ্বলন্ত উনুনের মতো লাগত বলে তিনচুলে নাম। গুম্বাদাঁড়া ছাড়াও তিনচুলেতে আর একটি ভিউ-পয়েন্ট আছে। সকালে এখান থেকেও সূর্যোদয়ের দৃশ্য চমৎকার।
অন্যদিকে পাহাড়ের খাঁজে জমাটবাঁধা মেঘের ওপর সূর্যের আলোর প্রতিফলনে এক মায়াবী, স্নিগ্ধ পরিবেশ তৈরি হয়। পরিস্কার আকাশে এই ভিউ-পয়েন্ট থেকে কালিম্পং, তিস্তাভ্যালি, সিকিম, টাইগার হিল দৃশ্যমান। সন্ধ্যাবেলা কালিম্পং পাহাড়ে জ্বলে ওঠে জোনাকির মত আলোকমালা।
তাকদা-তিনচুলেকে ঘিরে অপূর্ব সব চা-বাগান | Tea Garden at Takdah Darjeeling
তিনচুলের সিন্ডিকেট থেকে সারাদিনের জন্য একটা গাড়িভাড়া করে বেরিয়ে পড়লাম আশপাশটা ঘুরে দেখার জন্য। তারমধ্যে প্রধান লক্ষ্য তাকদা-তিনচুলেকে ঘিরে অপূর্ব সব চা-বাগানগুলি। প্রথমেই গেলাম তাকদা মনাস্ট্রি। একদম নিরিবিলিতে এই মনাস্ট্রি বেশ মনকাড়া। ভেতরে অপূর্ব বুদ্ধমূর্তি আর নানা রঙবেরঙের দেওয়াল চিত্র। তিনচুলে থেকে তাকদা ৩ কিমি। তাকদার উচ্চতা ৪,০০০ ফুট।
তাকদা থেকে লামাহাট্টা যাওয়ার একটা ট্রেক-রুট আছে। মেঘ আর সবুজে ঘেরা তাকদারও আলাদা আকর্ষণ আছে। তাকদার অন্যতম দ্রষ্টব্য তাকদা ব্রিটিশ বাংলো, এখানে পর্যটকদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাও আছে। দু-একদিন এখানে থেকেও এক বিরল অভিজ্ঞতা অর্জন করা যায়। তাকদার আর এক আকর্ষণ অর্কিড সেন্টার, বেশ অনেকটা জায়গাজুড়ে সুন্দর করে সাজানো।
এরপর গেলাম পুবং হাঙ্গিং ব্রীজ দেখতে। আসল উদ্দেশ্য গ্রামটা দেখা। এখানেও দু-তিনটি ছোট হোমস্টে হয়েছে দেখলাম। এই গ্রামে ১০০ বছরের পুরনো একটি ঝুলন্ত ব্রীজ আছে গ্রামবাসীদের ব্যবহারের জন্য। তাকদা-তিনচুলেকে ঘিরে পেশক, লপচু, রংলিরংলিয়ট, গিলে চা-,বাগানগুলি ঘুরে দেখতে সারাদিন কেটে গেল। দিগন্ত-বিস্তৃত চা-বাগানগুলিতে রঙিন পোশাক পরে ঝুড়ি-পিঠে মেয়েদের চা-তোলার অপূর্ব সব দৃশ্যপট। এখানেই প্রথম দেখলাম সাদা রঙের চা-ফুল। এছাড়াও পথেই পড়বে দূরবীনদাঁড়া ভিউ-পয়েন্ট, তিস্তাভ্যালি ভিউ-পয়েন্ট।
এতসব ঘুরে তিনচুলে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। তিনচুলের উষ্ণ আতিথেয়তায় আর সবুজ সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হয়ে কেটে গেল দুটো দিন। ফিরে চলি শিলিগুড়ির পথে।
কিভাবে যাবেন:- How to reach Tinchuley , Darjeeling.
হাওড়া বা শিয়ালদহ থেকে উত্তরবঙ্গের যে-কোন ট্রেনে নিউ-জলপাইগুড়ি অথবা বাসে শিলিগুড়ি, বিমানে বাগডোগরা পৌঁছে, সেখান থেকে সরাসরি বা দার্জিলিং/কালিম্পং হয়ে পৌঁছনো যায় তিনচুলে।
নিউ-জলপাইগুড়ি অথবা বাগডোগরা এয়ারপোর্ট থেকে তিনচুলে প্রায় ৭৫-৮০ কিমি। সময় লাগে তিন/সাড়েতিন ঘন্টা।
কালিম্পং থেকে তিনচুলে ৪০ কিমি আর দার্জিলিং থেকে ৩২ কিমি।
শুধু তাকদা-তিনচুলে-লামাহাট্টা ঘুরতে চাইলে যাওয়া-আসা ধরে ৪-৫ দিন যথেষ্ট। এর সাথে আরো দু-দিন জুড়ে নিলে লেপচাজগৎ ঘুরে নেওয়া যায়।
কখন যাবেন| Best time to visit Tinchuley.
সারা বছর যাওয়া যায়। বিভিন্ন ঋতুতে তিনচুলের আলাদা আলাদা রূপ দেখা যায়।
কোথায় থাকবেন:- Hotel/Homestay Lamahatta , Tinchuley.
লামাহাট্টায় থাকার জন্য লামাহাট্টা লজ, লামাহাট্টা ড্রুক হোমস্টে, মাউন্টেন ভিউ প্রভৃতি নিয়ে মোট ৪-৫ টি হোমস্টে আছে। তিনচুলেতে থাকার জন্য অভিরাজ হোমস্টে, গুরুং কটেজ, রাই রিসোর্ট এছাড়াও আরো বেশ কিছু হোমস্টে আছে।
প্রয়োজনীয় দূরত্ব| Distance Between
- নিউ জলপাইগুড়ি/বাগডোগরা থেকে তিনচুলে ৮০ কিমি. NJP to Tinchuley 80 k.m.
- দার্জিলিং থেকে লামাহাট্টা ২৩ কিমি. lamahatta to darjeeling 23 k.m.
- দার্জিলিং থেকে তিনচুলে ৩২ কিমি. Darjeeling to Tinchuley 32 k.m.
- লামাহাট্টা থেকে তিনচুলে ৯ কিমি. Lamahatta to Tinchuley 9 k.m.
- ঘুম থেকে তিনচুলে ২০ কিমি.. Ghoom to Tinchuley 20 k.m.
- লেপচাজগৎ থেকে তিনচুলে ২৭ কিমি. Lepchajagat to Tinchuley 27 k.m.