পারো, হা-উপত্যকা, তাকসাং মনাস্ট্রি ভুটান ভ্রমণ | Paro, Haa-Valley Taktsang Monastery in Bhutan Tour

রাতের আলোকিত পারো-জং
রাতের আলোকিত পারো-জং

ভুটানের সুন্দরতম উপত্যকা পারো | Paro Beauty of Valley , Bhutan

বুমথাং থেকে পেলেলা ফিরে , অন্য পথে আধ-ঘন্টা গেলেই ফোবজিকা। ফোবজিকাতে একরাত কাটিয়ে আবার পেলেলা পৌঁছে একই পথে রওনা হই ভুটানের সুন্দরতম উপত্যকা পারোর উদ্দেশ্যে। আমাদের ড্রাইভার কর্মাজির মতেও ভুটানের সবচেয়ে সুন্দর জায়গা পারো। কর্মাজির কাছে বাংলা গানের প্রচুর সংগ্রহ। আমাদের দশ দিনের দীর্ঘ ভুটান সফরে নিত্য-নতুন বাংলা গান শুনিয়ে যাচ্ছেন। তার সাথে হিন্দি , ভুটানি গান তো আছেই। খুব ভালো মানুষ। শান্ত-শিষ্ট নম্র স্বভাব। আমাদের লাল-চালের ভাত খাইয়েছিলেন ট্রংসাতে। সব জায়গাতেই ওনার পছন্দের খাবার লাল-চালের ভাত আর সামু-দাৎসি অর্থাৎ মাশরুম-চীজ দিয়ে তৈরি। আমারও যা ভীষণ পছন্দ হয়েছে এই দাৎসিগুলো যার গ্রেভি চীজ দিয়ে তৈরি। কেওয়া দাৎসি অর্থাৎ আলু-চীজ, এমা-দাৎসি অর্থাৎ লঙ্কা-চীজ আর ঝা-চু মানে ডাল। একদমই নির্লোভ একজন মানুষ কর্মাজি। তবে ভূতে ভয় পান ,আর একটু ভীতু স্বভাবের। গাড়ি চালানোর সময় একদমই তাড়াহুড়ো করেন না। তাতে আমাদের ভালোই হয়েছে, ধীরে সুস্থে সব জায়গাগুলো দেখা হচ্ছে। ওনার আন্তরিকতা মনে রাখার মতোই।

রোমাঞ্চকর এক যাত্রাপথ বুমথাং ভুটান ভ্রমণ

পারোর উদ্দেশ্যে পাড়ি । Way to Paro , Bhutan

পেলেলা থেকে একই পথে লোবেসা হয়ে থিম্পুকে পাশ কাটিয়ে ছুজমে কনফ্লুয়েন্স-ব্রীজের কাছে ফিরে গিয়ে পারো নদীকে সঙ্গী করে এগিয়ে চলি। পারো শহরের ৪ কিমি আগে ভুটানের একমাত্র বিমানবন্দর ঠিক ছবির মতো। তিনটি পাহাড়ের তলদেশে একখণ্ড সমতলভূমির ওপর এই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটি। পারো নদীর উপত্যকার ঠিক মাঝখানে অবস্থিত পারো শহর। পারোর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য অফুরান। চারিদিকে পাহাড়ের সবুজায়ন, দিগন্তবিস্তৃত সোনালি ফসলের খেত, ফলের বাগান, দূরে তুষার-শৃঙ্গের হাতছানি, মাঝে মাঝে ভুটানিশৈলীতে অলংকৃত বাড়িঘর----সবমিলিয়ে পারো অনন্য। পারোর উচ্চতা ৭,৭৫০ ফুট। টিলার মাথায় রিংপুং জং বা পারো জং। এখানে প্রবেশের জন্য পারমিট দেখাতে হয়। জং-এর কাছেই দুংচি লাখাং বা বৌদ্ধগুম্ফা। জং-এর প্রবেশের মুখে রয়েছে অসাধারণ কিছু দেওয়াল চিত্র। জং-এর অন্দরে বৌদ্ধগুম্ফা, প্রশাসনিক নানা অফিস, বিচারসভা ইত্যাদি রয়েছে। একঘন্টার ওপর লেগে গেল জং টি ভালো করে দেখতে। জং-এর ঠিক উপরে রয়েছে ন্যাশনাল মিউজিয়াম। অতীতের দুর্গ এখন মিউজিয়াম। ভুটানের দেড়হাজার বছরের ইতিহাসের দলিল যেন এই মিউজিয়াম।

পারোতে আমাদের তিনটি রাতের আস্তানা হোটেল ফুনসুম। এই হোটেলটিতে থাকার কারণ একদিকে উপত্যকার দৃশ্য আর অন্যদিকে রাতের পারো জং-এর আলোকিত রূপ। নাহলে হোটেল ড্রাগনও বেশ ভালো। বিশেষ করে হোটেল ড্রাগনের খাবার বেশ ভালো।


হা-উপত্যকা | Haa-Valley in West Bhutan

পারোতে প্রথম রাত কাটিয়ে বেশ সকালেই আমরা বেরিয়ে পরেছি হা-উপত্যকার উদ্দেশ্যে। হা-উপত্যকা যাওয়ার জন্য পারমিট সংগ্রহ করতে হয় থিম্পু থেকে। পারো থেকে হা-উপত্যকার দূরত্ব ৬২ কিমি। পারো বিমানবন্দরের রাস্তা পেরিয়ে বেশ চড়াই পথের শুরু। একটু পর থেকেই জনবসতি শেষ আর দু-ধারে পাইন ফারের জঙ্গল। আজ ২রা জানুয়ারি । পাহাড়ের গা বেয়ে ঝর্ণাগুলি সব জমে বরফ। 

হা-উপত্যকার পথে
হা-উপত্যকার পথে

উচ্চতার সঙ্গে বাড়ছে ঠান্ডা হাওয়ার দাপট। পারো থেকে ৩৬ কিমি পথ পেরিয়ে পৌঁছলাম চেলে-লা( উচ্চতা ১৩,০০০ ফুট) শীর্ষবিন্দুতে। পাস-শীর্ষে রঙিন পতাকার সারি, চারদিক ঘিরে রয়েছে তুষারশৃঙ্গ। চেলে-লা থেকে এবার উৎরাই। ঢালু পথ বেয়ে ২৬ কিমি দূরে হা-উপত্যকা। 

এখানে প্রধান আকর্ষণ হা-জং। এছাড়া আছে লাখাং কারপো (white temple) আর লাখাং নাগপো (black temple)। এখানে একটি মিলিটারি হসপিটালও আছে। হা-উপত্যকা সমতল হলেও মাঝে মাঝেই সুউচ্চ টিলা যেন মাটি ফুঁড়ে উঠেছে। উপত্যকা জুড়ে সবুজ শস্যক্ষেত্র---- প্রধানতঃ হা নদীর অববাহিকা অঞ্চলে। হা সত্যিই নির্জন , পর্যটকদের প্রায় দেখাই মেলে না। 

ফেরার সময় চেলে-লা শীর্ষে শুরু হল প্রবল তুষারপাত। একেবারেই বিপরীত রূপ! সকালেই দেখে গেলাম ঝকঝকে নীল আকাশে তুষারশৃঙ্গের সারি। যদিও পাহাড়ের এই উচ্চতায় এটা খুব স্বভাবিক ঘটনা।  হঠাৎ করেই যেন চারদিক সাদা চাদরে কেউ মুড়ে দিল। তার মধ্যেই ফিরে চলি পারোর উদ্দেশ্যে।


পারোর অন্যান্য দ্রষ্টব্য স্থান । Places to Visit/Sightseeing in Paro , Bhutan

পারো শহর ছাড়িয়ে ১৫ কিমি দূরে ড্রুক গিয়েল জং। আজ দূর থেকে দেখলাম পারো চু-র অপর পারে বৃক্ষহীন স্লেট পাথরের খাঁড়া পাহাড়ের খাঁজে তাকসাং গুম্ফা বা বাঘের বাসা। আগামীকাল সারাদিন বরাদ্দ এই তাকসাং গুম্ফার জন্য। কারণ ৬ কিমি হেঁটে উঠতে হবে এই গুম্ফায়, সময় লাগে প্রায় তিনঘন্টা। পৌঁছে গেলাম পারোর শেষ সীমায় ড্রুক গিয়েল জং যা এখন ধ্বংসপ্রাপ্ত। অনুচ্চ এক টিলার ওপর এই জং গভীরভাবে ঐতিহাসিক। এই দুর্গ নির্মিত হয় সপ্তদশ শতাব্দীতে তিব্বতি হানাদারদের প্রতিহত করার জন্য। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য অবর্ণনীয়। পথে এক ঝলক দেখা মিলল বরফাচ্ছাদিত শিখর চুমোলহরির নয়নাভিরাম রূপের।

এবার পারোর দিকে এগিয়ে এসে পৌঁছলাম কিচু গুম্ফা। অপরূপ প্রকৃতির মাঝে সপ্তম শতকে নির্মিত এক প্রাচীন গুম্ফা কিচু। এটি রাজমাতার উপাসনা গৃহ। সাদা রঙের সুদৃশ্য গুম্ফাটির চূড়া সম্পূর্ণ সোনার। ভিতরে ছয় মিটার উঁচু সোনার গিল্টি করা সুন্দর কারুকার্যখচিত গুরু পদ্মসম্ভবের মূর্তিটি দেখবার মতো। দেওয়ালে অতো পুরোনো ফ্রেসকো এখনো উজ্জ্বল। এরপর আমরা এই গুম্ফাটির সামনে একটি ছোটো চোর্তেনে ঢুকলাম। আর এখানেই দেখলাম একটি গাছ ভর্তি কমলালেবু ঝুলছে। ভুটানের বেশিরভাগ লাখাং এই মাথার টুপি খুলে ভেতরে ঢোকা নিয়ম।

তাকসাং মনাস্ট্রি
তাকসাং মনাস্ট্রি

বাঘের গুহা | Tiger's Nest, Taktsang Monastery, A Sacred Buddhist site Paro , Bhutan

আজ আমাদের ভুটান ভ্রমণের শেষ দিন। আজকের দিনটার জন্যই আমার ভুটান আসা, ভুটান ভ্রমণের পরিকল্পনা শুরু করা। তা হলো বাঘের বাসায় পদার্পণ। পারো শহর থেকে সকাল সকাল কর্মাজি আমাদের পৌঁছে দিলেন হাঁটা পথের শুরুতে। বার বার বললেন ধীরে সুস্থে যেতে , বেশি ঝোঁকাঝুঁকি না করতে । বুঝতে পারছিলাম যে সারাদিন আমাদের একা ছাড়তে উনি বেশ চিন্তিত ! এতোদিন টানা ঝকঝকে নীল আকাশ , ঝলমলে রোদ্দুর পেয়েছিলাম কিন্তু আজ আকাশ মেঘলা । এখন জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ ওপরে তুষারপাত শুরু হয়ে গেছে নিয়ম করে । পাহাড়ের নীচে অনেক ঘোড়া অপেক্ষা করছে কিন্তু আমরা হেঁটেই উঠবো ঠিক করে এসেছি।

তাকসাং মনাস্ট্রি বা টাইগারস নেস্ট ভুটানের পবিত্রতম স্থানগুলির মধ্যে অন্যতম। পারো থেকে ছয় কিমি হাঁটাপথে পৌঁছতে হয় এখানে। দূর থেকে দেখলেই বোঝা যায় এর অবস্থান মাহাত্ম্য। মনে হবে খাঁড়া পাহাড়ের গায়ে অদ্ভুতভাবে আটকে আছে এই গুম্ফাটি। যতই এগোতে থাকি ততই যেন আকর্ষণ বাড়তে থাকে এ পথের। কিছুটা পথ এগিয়ে যেতেই প্রচুর গাছ-গাছালি বনের আকার ধারণ করেছে। 

গাছের ফাঁক দিয়ে অনেক দূরে গুম্ফাটি দেখা যাচ্ছে মাঝে মাঝে। হাঁটা ছাড়াও মনাস্ট্রির দু-কিমি আগে পর্য্ন্ত ঘোড়া বা খচ্চরের পিঠেও ওঠা যায়। কিন্তু নামতে হবে হাঁটা পথেই। অনেকেই বলেন , শুধু একটা মনাস্ট্রি দেখার জন্য এতো হাঁটবো কেন! ওঠা-নামা নিয়ে ১২ কিমি। সারাদিনের ব্যাপার। তাদের বলবো একবার অন্ততঃ যান একটু কষ্ট করে নিজে থেকেই সব প্রশ্নের উত্তর পাবেন। সমগ্র ভুটানের মানুষজন তো বটেই দূর-দূরান্ত থেকে যাত্রী আসেন অতি পবিত্র এই স্থানে, কেউ তীর্থের টানে আবার কেউ শুধুই অনাবিল প্রকৃতির টানে। এই মনাস্ট্রির ছবি দেখেই আমার ভুটানে আসার ইচ্ছে প্রবল হয়েছিলো। মুগ্ধ আর বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম! তখনই মনে হয়েছিল সুযোগ পেলে এখানে যেতেই হবে একবার। মনাস্ট্রির যত কাছে এগিয়ে যাচ্ছি রোমাঞ্চিত হচ্ছি। আরো সুন্দর থেকে সুন্দরতর হয়ে উঠছে যাত্রাপথ যা নীচ থেকে বোঝা একেবারেই সম্ভব নয়। এ পথে বর্ষাকালে আসা উচিত নয়, কাদায় পথ পিচ্ছিল থাকে। এই মনোমুগ্ধকর স্থাপত্যটি ভুটানের বেসরকারি প্রতীক হিসেবেও চিহ্নিত হয়। কথিত আছে, গুরু পদ্মসম্ভব ভুটানে বৌদ্ধধর্ম প্রচারে এসে, এখানে এসেছিলেন একটি উড়ন্ত বাঘিনীর পিঠে চড়ে। ভুটানে বৌদ্ধধর্মের প্রথম প্রবেশও হল এরই সঙ্গে। ভুটানে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের তুলনায় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যাই বেশি। অন্যান্য ধর্ম সেই তুলনায় অনেক কম। বৌদ্ধগুম্ফার এই দেশে মনাস্ট্রিগুলি এত সুন্দর, শান্ত যে মন ভালো হয়ে যায় আপনার থেকেই। গুম্ফায় প্রবেশের আগে অনুমতিপত্র দেখাতে হয় আর গুম্ফাটি দুপুর ১ টা থেকে ২ টো বন্ধ থাকে। পারো আমাদের মন ভরিয়ে দিয়েছে। পারো এতটাই সুন্দর ----ইচ্ছে রইলো ভুটানের আর কোথাও যাই আর না যাই , পারো আবার আসবো।


পারো ভ্রমণের জন্য জেনে রাখুন |  Paro , Bhutan Tour Information

  • পারো ভ্রমণের জন্য অনুমতিপত্র সংগ্রহ করতে হয় ফুন্টশেলিং বা পারো বিমানবন্দর থেকে কিন্তু হা-উপত্যকা যাওয়ার জন্য অনুমতিপত্র থিম্পু থেকে সংগ্রহ করতে হবে।
  • পারো জং এবং তাকসাং মনাস্ট্রিতে প্রবেশ করার আগে পারমিট দেখাতে হবে।
  • তাকসাং মনাস্ট্রি দুপুর ১টা থেকে ২টো বন্ধ থাকে।
  • বর্ষার সময় তাকসাং মনাস্ট্রির রাস্তা কাদায় পিচ্ছিল থাকে।
  • তাকসাং মনাস্ট্রির ২ কিমি আগে পর্য্ন্ত ঘোড়া যায়, ওই ২ কিমি পথ হেঁটে উঠতে হয়। নামার সময় পুরোটাই মানে ছয় কিমি পথ হেঁটেই নামতে হয়।
  • মোট দূরত্ব ছয় কিমি। হেঁটে গেলে পৌঁছতে সময় লাগে প্রায় তিন-সাড়েতিন ঘন্টা , হাঁটার ওপর নির্ভর করছে। ওঠা-নামা মিলিয়ে মোট বারো কিমি হাঁটা।
  • পথে একটাই খাবার জায়গা আছে , স্বাভাবিকভাবেই খাবারের দাম অনেকটাই বেশি।

পারোর দূরত্ব | Distance Between 

  • থিম্পু থেকে পারোর দূরত্ব ৬৫ কিমি। Thimphu to Paro 65 k.m.
  • পুনাখা থেকে পারোর দূরত্ব ৫৫ কিমি। Punakha to Paro 55 k.m.
  • বুমথাং থেকে পারোর দূরত্ব প্রায় ২৮০ কিমি। Bumthang to Paro 280 k.m.
  • পারো থেকে হা-উপত্যকার দূরত্ব ৬২ কিমি। Paro to Ha - Valley 62 k.m.

কিভাবে যাবেন| How to visit Paro , Bhutan

কোলকাতা/হাওড়া থেকে ট্রেনে নিউ জলপাইগুড়ি/হাসিমারা। তারপর সড়কপথে জয়গাঁ, ফুন্টশেলিং হয়ে পারো। আকাশপথে বিমানে সরাসরি পারো পৌঁছনো যায়।

কখন যাবেন | Best time to visit Paro , Bhutan

বর্ষাকাল বাদ দিয়ে বছরের যেকোনো সময়। তবে খুব ঠান্ডার সময় বরফের জন্য হা-উপত্যকা ঘোরা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।


থাকার জায়গা | Hotels at Paro , Bhutan

  • Hotel Phunsum
  • Hotel Dragon

ইত্যাদি।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন