এক ঐতিহ্য সংস্কৃতির শহর বুমথাং ভুটান | Historic Place Bumthang , Bhutan
কাছের বিদেশ ভুটান এখন পর্যটকমহলে অতিপরিচিত একটি নাম। শান্ত, সুন্দর, সমাহিত --- ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির দেশ ভুটান। তবুও যেন চিরাচরিত কিছু জায়গা ছাড়া বাকি অন্যান্য আরো বেশ কিছু সৌন্দর্য্যের নিকেতন বেশিরভাগ পর্যটকদের কাছে অধরাই থেকে গেছে। অনেককেই বলতে শুনেছি ডুয়ার্স আর ভুটান ঘুরে এলাম! এক্ষেত্রে ভুটান বলতে হয়তো শুধুই ফুন্টশেলিং। নাহলে থিম্পু, পারো বড়োজোর পুনাখা। অর্থাৎ পশ্চিম ভূটানেই সীমাবদ্ধ ।
আরও পড়ুন
পারো, হা-উপত্যকা, তাকসাং মনাস্ট্রি
পূর্ব এবং মধ্য ভুটানে তুলনামূলকভাবে অনেক কম পর্যটক যান । এর প্রধান কারণ হল ---- থিম্পু , পারো, পুনাখা ঘুরতে যা দিন বা খরচ লাগে পূর্ব এবং মধ্য ভুটানের ফোবজিকা , ট্রংসা, বুমথাং ইত্যাদি যোগ করলে ভ্রমণ দিবস এবং খরচা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়। ধকলও অনেক বেশি। কারণ, পশ্চিম ভুটানে যেমন ঝাঁ-চকচকে রাস্তা আমরা দেখি বুমথাং পর্যন্ত রাস্তা কিন্তু তেমন নয়। এ হলো হিমালয়ের অন্দরমহল ---ধূলো ওড়ানো, মাটির কাঁচা রাস্তা ধরে অনেকটা পথ যেতে হয়। তাই বহুচর্চিত থিম্পু, পারো, পুনাখায় থাকা-খাওয়া, দ্রষ্টব্য , পারমিট ইত্যাদির ব্যাপারে এখন আমি না গিয়ে সরাসরি বুমথাংপ্রসঙ্গেই বলবো ।
অদ্ভুত রোমাঞ্চকর এক যাত্রাপথ বুমথাংয়ের পথে । Way to Bumthang , Bhutan
খুব সকাল সকাল বেরিয়েছি আমরা পুনাখা থেকে বুমথাং-এর উদ্দেশ্যে , পাড়ি দিতে হবে অনেকটা পথ। পুনাখা থেকে লোবেসা ১৪ কিমি। সরাসরি থিম্পু থেকে বুমথাং যেতে হলে পুনাখা যাওয়ার দরকার হয়না। লোবেসা থেকে ৯ কিমি দূরে ওয়াংদিফোদরং। পুনাখা চু আর তাং চু বয়ে চলেছে নীচ দিয়ে। পাহাড়ের মাথায় ওয়াংদিফোদরং জং। শবড্রুং নামগিয়েল ১৬৩৯ সালে তিব্বতিদের সঙ্গে যুদ্ধজয়ের স্মারক হিসেবে এই জং নির্মাণ করেন।পারিপার্শ্বিক সৌন্দর্য্য মুগ্ধ করার মতো। নদীর ওপারে সুপরিকল্পিত বাজো শহর। ওয়াংদি শহরের কেন্দ্রস্থলেই বাসস্ট্যান্ড আর তার চারদিক ঘিরে দোকানবাজার, বাড়িঘর। ওয়াংদি থেকে নদীকে সঙ্গী করে খাড়াই পথ ধরে গাড়ি ক্রমশঃ উপরে উঠতে লাগল। আকাশ ঘননীল, দূরে পাহাড়ের সারি, কখনও পাহাড়ের গায়ে ধাপে ধাপে চাষ আবাদ হচ্ছে। ক্রমে চগশা, নবডুং, ছুজমসা গবজিখা পেরিয়ে পৌঁছে যাই পেলে-লা শীর্ষে। লা অর্থাৎ পাস। ১৩০০০ ফুট উচ্চ এই পাস থেকে চারপাশের দৃশ্য অপূর্ব। এখানে রয়েছে এক সাদা চোর্তেন ঘিরে প্রার্থনা পতাকার সারি। ঠান্ডা হাওয়ার বেশ দাপট। তারওপর সময়টা ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহ। পেলে-লা থেকে এবার উৎরাই পথ।
অন্যপথে প্রায় আধঘন্টা গেলেই ফোবজিকা যা শীতকালে আসা ব্ল্যাক নেকড ক্রেনের(পরিযায়ী পাখি) জন্য প্রসিদ্ধ। এই পথে ফেরার সময় যাবো। রুকুবজি , চাজাম গ্রাম পার হয়ে গাড়ি থামল ছেনদেবজি চোর্তেনের সামনে। এই চোর্তেন নেপালীশৈলীতে তৈরি। এরপর তাসিলিং পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম একটি বড়ো জনপদ ট্রংসায়। ওয়াংদি থেকে ট্রংসার দূরত্ব প্রায় ১২১ কিমি।
পুনাখা থেকে পেলেলা প্রায় তিন ঘন্টার পথ আর পেলেলা থেকে ট্রংসাও তিন/সাড়ে তিন ঘন্টার পথ। পূর্ব-ভুটানের প্রবেশদ্বার এই ট্রংসা। সামনেই বিশাল ট্রংসা জং। আকারে এটি ভূটানের বৃহত্তম জং। ১৬৪৮ সালে শবড্রুং নামগিয়েল ২০টি গুমফাকে একত্রিত করে গড়ে তোলেন এই ট্রংসা জং। ট্রংসা শহর ঘিরে রয়েছে আকাশছোঁয়া ফার-পাইন-বার্চ গাছ। বেশ আধুনিক শহর এই ট্রংসা । যানবাহন, পর্যটকের সংখ্যা এপথে খুবই কম। রাজা-রানীকেও বুমথাং আসতে গেলে সপার্ষদ হেলিকপ্টারেই আসতে হয়।
ট্রংসা থেকে বুমথাং ৮০ কিমি। আরো সাড়ে তিন ঘন্টার পথ। পাহাড়ের গা বেয়ে নেমেছে একের পর এক ঝর্ণা। বেশিরভাগই জমে বরফ। পর পর পেরিয়ে যাচ্ছি হেয়ারপিন বাঁক। রাস্তার হালও বেশ খারাপ। পেরিয়ে গেলাম ইয়েতোং-লা ( ১৬০০০ ফুট)। এরপর প্রায় ৬,০০০ ফুট উৎরাই পথে নেমে আসার পর বেশ অনেকটা প্রশস্ত সামতলভূমির ওপর দিয়ে চলেছি। পথের দুধারে চাষের ক্ষেত। অন্ধকার হয়ে আসছে। তবু বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না, বুমথাং-এর বৈশিষ্ট্য অন্যান্য জায়গার থেকে একেবারেই আলাদা। একেই অন্যরকম একটা জায়গা যার সবকিছুই স্বতন্ত্র তারওপর অন্ধকার নেমে আসছে ---- সবমিলিয়ে অদ্ভুত এক রোমাঞ্চকর লাগছিল এই যাত্রা! ঘুটঘুটে অন্ধকারে প্রবেশ করলাম অ্যালপাইন অরণ্যের গভীরে। এই অরণ্য পেরিয়ে বুমথাং উপত্যকা । বুমথাং নদীর তীর ধরে পথ।
বার্থ প্লেস অফ বুদ্ধইজম | Birthplace of Buddhism Bumthang
সকালে ঘুম থেকে উঠে যেদিকেই তাকাই শুধু মুগ্ধতা আর বিস্ময়! ভুটানিশৈলীর বাড়িঘর, দূরে ঢেউখেলানো পাহাড়, অসাধারণ সুন্দর প্রকৃতি আর সব কিছুর ঊর্ধ্বে প্রশান্তি। চারটি উপত্যকার সমাহার এই বুমথাং ধর্মীয়ভাবে সমৃদ্ধ । বহু ধর্মগুরু এখানে অধিষ্ঠান করেছেন। বৌদ্ধশিক্ষক পেমালিংপার ঐতিহ্যশালী গৃহ এখানেই।
ব্রেকফাস্ট করার জন্য মার্কেট প্লেসে এসে দেখলাম গতকাল আগুন লেগে বেশ কিছু দোকানপাট পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। তাই রাজা-রানীর আগমন হেতু মুহুর্মুহু হেলিকপ্টারের আনাগোনা লেগেই আছে। বুমথাং উপত্যকার প্রধান শহর জাকার । জাকার শহরের কেন্দ্রবিন্দু চোমখর, সেখান থেকে ৫ কিমি দূরে মে-বার সো অর্থাৎ হ্রদ। বুমথাং নদীর একটি ধারা স্থলভূমির মধ্যে ঢুকে এসে হ্রদের আকার নিয়েছে। হ্রদের দুপাশে খাঁড়া পাহাড়ের দেওয়াল। দুটি পাহাড় সেতু দিয়ে যুক্ত, নীচে বয়ে যাচ্ছে জলের ধারা। পাহাড়ের গায়েই মোমবাতি , ধূপ জ্বালিয়ে পুজো দেন এখানকার মানুষ ---- তাদের কাছে এ স্থল অত্যন্ত পবিত্র। সমগ্র ভুটানের মধ্যে জাকার ই প্রথম স্থান যেখানে গুরু রিমপোচে প্রথম পদার্পণ করেন। কথিত আছে, গুরু রিমপোচে এই হ্রদের নীচে কিছু পবিত্র সম্পদ লুকিয়ে রেখে যান। ১৪৭৫ সালে বৌদ্ধ শিক্ষক পেমালিংপা একটি জ্বলন্ত মাখনের প্রদীপ হাতে এই হ্রদে ঝাঁপ দেন এবং ওই সম্পদগুলি উদ্ধার করেন---- একটি মূর্তি, একটি স্ক্রিপ্ট (script) এবং একটি ঋচুয়াল স্কাল (ritual skull)। উনি এগুলি নিয়ে যখন হ্রদ থেকে উঠে এলেন তখনও প্রদীপটি জ্বলছিল! তখন থেকেই হৃদটির নাম Burning Lake অর্থাৎ মে-বার সো। পেমালিংপার জন্মস্থানও এই জাকার অঞ্চলে। জাকারকে ভুটানিদের " বার্থ প্লেস অফ বুদ্ধইজম " বলা হয়।
এবার যাওয়া হল জাকার জং দেখতে। স্থানীয় লোকেদের মুখে শ্বেতপক্ষীর নগরদুর্গ বলে খ্যাতি আছে এই জং এর। কথিত আছে, একদল লামা বৌদ্ধধর্মের একটি সংঘ স্থাপনের জন্য একটি মনমতো জায়গার অন্বেষণ করছিলেন, ছোট্ট এক সাদা পাখি ক্রমাগত তাঁদের মাথার ওপর উড়ছিল যতক্ষণ না তাঁরা স্থানটি সুনিশ্চিত করেন। এটি তাঁদের কাছে খুবই শুভ সংকেত ছিল। তাই তাঁরা এই পাহাড়ি অঞ্চলটিকে ওই সাদা পাখিটির নামেই চিহ্নিত করেন।
জাকার জং , পুনাখা জং এবং পারো জং---- ভুটানের এই তিনটি দর্শনীয় স্থানকে একত্রে গোল্ডেন ট্রাঙ্গল (golden triangle) বলা হয়। স্থাপত্যে এবং ভাস্কর্যে বুমথাং ভুটানের অন্যতম এবং অনন্যসাধারণ জং। পুরো জংটাই কারুকার্যের যাদুপুরী। দরজা-জানালা কড়ি-বরগা এমনকি স্তম্ভগুলিতেও বহুবর্ণে রঞ্জিত দারুশিল্প। বৌদ্ধমন্দির , বিচারসভা, বুদ্ধ ও অন্যান্য দেবদেবীর মূর্তি, গুম্ফা, সরকারি নানা দফতর সবই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে জং এর অন্দরে।
বুমথাং-এর অন্যান্য দ্রষ্টব্য স্থান | More other Places to Visit in Bumthang
মধু উৎপাদন কেন্দ্র হিসাবেও খ্যাতি আছে বুমথাং-এর। চিজ কারখানাটিও দেখে নেওয়া যেতে পারে। বুমথাং উপত্যকার নানাদিকে ছড়িয়ে রয়েছে অনেকগুলি লাখাং। লাখাং হলো মন্দির বা ঈশ্বরের আবাস।----শুধু আরাধনার স্থান নয় শৈল্পিক চেতনা ও আধ্যাত্মিক সভ্যতার প্রতীক। এ অঞ্চলের সবচেয়ে প্রাচীন লাখাং হল জাম্বে লাখাং। লাখাং-এর অন্দরে মহাকাল মূর্তি, অন্যদিকে বুদ্ধমূর্তি ও দলাই লামার ছবি। ৬৩৮ সালে তিব্বতের রাজা সাংতেন গামপো হিমালয় অঞ্চলে কোন শয়তানি আত্মাকে দমন করার জন্য একরাতে ১০৮টি গুম্ফা তৈরি করেন, এটি তাদের মধ্যে একটি। সুবিশাল বৌদ্ধবিহার কুর্জে লাখাং, তিনটি অট্টালিকায় ঘেরা। এই অট্টালিকাগুলিকে ঘিরে রেখেছে ১০৮টি চোর্তেন । এখানে একটি সুউচ্চ সাইপ্রাস বৃক্ষ রয়েছে। এছাড়া তামসিং লাখাং, চোখার লাখাং দ্রষ্টব্য।
প্রাচীন ও আধুনিকতার এক সুন্দর মেলবন্ধন সমগ্র ভুটানেই। সব কিছুই সুন্দর , সব কিছুই শান্তির। সর্বোপরি বুমথাং তথা সমগ্র ভুটানের বৈচিত্র্যময় আকাশও যেন মুগ্ধ করে । সর্বত্র সত্য শিব সুন্দরের বাণী।
কলকাতা থেকে বুমথাং ভুটান ভ্রমণের পূর্বে অবশ্যই জেনে রাখুন । Must know before visit to Bumthang
- বুমথাং যাওয়ার জন্য পারমিট সংগ্রহ করতে হবে থিম্পু থেকে।
- ভুটানে ভারতীয় মোবাইল সিম চলে না। তাসি সেল বা ভুটান টেলিকম এর সিম নিতে হবে।
- ভুটানিরা ভারতীয় টাকা পেতে বেশী পছন্দ করেন ভুটানের টাকার চেয়ে। ভারতীয় ৫০০ টাকার বেশ চাহিদা। আমার নিজস্ব অভিজ্ঞতা।
- বর্ষার সময় বুমথাং যাওয়া উচিত নয়। এছাড়া বছরের সবসময় যেতে পারেন।
- থিম্পু থেকে বুমথাং-এর দূরত্ব ২৭৬ কিমি।সময় ১২/১৩ ঘন্টা।Thimphu to Bumthang 276km
- পুনাখা থেকে বুমথাং-এর দূরত্ব ২২৪ কিমি। সময় ১০/১১ ঘন্টা। Punakha to Bumthang 224 km
বুমথাংয়ে থাকার জায়গা । Hotels at Bumthang
- Samayae Resort
- Swiss Guest House
- Yozerling Lodge