বড়ন্তি, পুরুলিয়া ভ্রমণ | Baranti Village Baranti Lake West Bengal

বড়ন্তি, পুরুলিয়া ভ্রমণ বৃত্তান্ত । Baranti Purulia WB Tour

অন্ততঃ একটি দিনের জন্য হলেও হারিয়ে যেতে চান রাঙামাটির পথের ধূলোয়---- ঘরের খুব কাছে, মাটির বড় কাছের, নাম তার বড়ন্তি (Baranti)।

Baranti Lake West Bengal

বড়ন্তি তখন 

আমি প্রথম গিয়েছিলাম ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। তখন বড়ন্তির এত নামডাক হয়নি। তখনও এখানকার মানুষ শহুরে মানুষে অভ্যস্ত হয়নি। মাত্র দুটো থাকার জায়গা ছিল-- তার মধ্যে একটি আদিবাসী গ্রামের মধ্যে বড়ন্তি ওয়াইল্ড লাইফ এন্ড নেচার স্টাডির দুটো ঘর, আরো একটি শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ঘর তৈরি হচ্ছিল সবে ইঁটের গাঁথুনি পড়েছিল। পিছনে বাঁধানো কূয়ো। রান্নাঘরে নিজের পছন্দমত রান্নার ব্যবস্থা। রাঁধুনির নাম জীবন। নিজেও বাজার করে দেওয়া যেত আবার টাকা দিলে ওরাও করে দিত। বাসনমাজা, ঘরমোছা, গ্যাসের সব আলাদা আলাদা খরচ। এখানে ইলেক্ট্রিসিটি ছিল। সামনেই সার দিয়ে শিশু গাছের পাতলা বনানী, তাতে অজস্র পাখির মেলা, টিনের চালে ঝরা পাতার গান, ঘরে বসেই শোনা যেত বাতাসের শনশন। সন্ধ্যে হতেই মনে হত কোনো জঙ্গলের বনবাংলোতে আছি। দূরে শিয়ালের ডাক। এখানকার জঙ্গলে হরিণ, নেকড়ে, খরগোশ, সজারু প্রভৃতি প্রাণীরও দেখা মেলে। নিঝুম নির্জনতায় আচ্ছন্ন একটা রাত। ভোর হতে না হতেই ঘরের জানলার কাঁচ দিয়ে গরুর গাড়ি যাওয়ার দৃশ্য, পাখির কলতান, কচি রোদ্দুরের লুটোপুটি। 

আর একটি থাকার জায়গা ছিল ঠিক বাঁধের ধারেই-- হাইল্যান্ড প্রজেক্টস এন্ড প্ল্যানটেশনের। এখানে তিনটি ঘর ছিল কিন্তু ইলেক্ট্রিসিটি ছিল না। 

বড়ন্তি এখন

এখন এসব অতীত! এই দশ বছরে প্রায় ১২-১৫ টি হোটেল/রিসোর্ট তৈরি হয়ে গেছে বড়ন্তিতে, বেশি তো কম নয়। আদিবাসী নৃত্যের সঙ্গে বার্বিকিউয়ের ব্যবস্থাও করা হয় এখন রিসোর্টগুলিতে। থাকা-খাওয়ার রেটও প্যাকেজে ধরা হয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। 

সেবার কথা হচ্ছিল এক সুঠামদেহী প্রবীণ ব্যক্তির সঙ্গে, তালবেড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা। নাম রামপ্রসাদ শান্তিকারী। 'শান্তিকারী' উপাধি পঞ্চকোট রাজাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত। এনার পূর্বপুরুষেরা ছিলেন পঞ্চকোট রাজার পুরোহিত বা রাজগুরু। পদবি হল চক্রবর্তী। বলছিলেন, লোকজন এলে খুব ভালো লাগে, তবু দুটো কথা বলা যায়। কথায় কথায় স্পঞ্জ আয়রণ কারখানার ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করছিলেন-- "বড়ন্তিতে একটি আর রামচন্দ্রপুরে আরো একটি স্পঞ্জ আয়রণ কারখানা হয়েছে। আরো কত কি দেখার ছিল---- গাছপালা, পশুপাখি সব মরে যাচ্ছে, জলে মাছ হচ্ছে না কারখানার দূষণে। পরিযায়ী পাখির ভিড় কমে আসছে। দূষিত ধোঁয়ায় দূরের পাহাড় আরো ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে।"

 হঠাৎ মাথার ওপর দিয়ে এক ঝাঁক টিয়া উড়ে গেল। মাঠে ঘুরছিলাম, এক মহিলা ডেকে দেখালেন পেঁচার ডিম। মাঠেই হালকা ঝোপে ডিম পেড়েছে। ছোট ছোট সাদার ওপর কমলা ছিটছিট। একটা বাচ্চা হাতে পলাশ ফুল দিয়ে গেলো। দোল আসতে তখনও পনেরো দিন বাকি ছিল। পলাশ গাছে সবে ফুল ধরতে শুরু করেছে আর কিছুদিন পর সিঁদুর রঙে ছেয়ে যাবে বড়ন্তি। সারা বড়ন্তি জুড়েই তো পলাশের বন। পলাশ ফুল জলে ফুটিয়ে বা শুকিয়ে গুঁড়ো করে খুব সুন্দর রঙ তৈরি হয়।

বড়ন্তি লেক | Baranti Lake

বড়ন্তির প্রাণকেন্দ্র এক জলাশয়, রামচন্দ্রপুর বাঁধ। গ্রামের মানুষের জলের চাহিদা মেটাতে এবং সেচের কাজে ব্যবহৃত হয় এই জল। মুরাডি স্টেশন থেকে মাত্র ৬ কিমি দূরে বড়ন্তি। জেলা পুরুলিয়া হলেও প্রপার পুরুলিয়া থেকে অনেক আগে। পৌঁছনোর পথও মন ভোলানো। শাল, শিশু, মহুয়া, পলাশের জঙ্গলে ছাওয়া কাছের পাহাড়, দূরের ঝাপসা পাহাড় সবাইমিলে আপনাকে সাদর অভ্যর্থনা জানাবে। তার সঙ্গে গ্রামের মানুষের অমলিন হাসি। এদের আন্তরিকতায় আপনি মুগ্ধ হবেন।

আরো কিছুটা এগুতেই চোখে পড়বে বড়ন্তির টলটলে জলের বাঁধ। বাঁধের ধার দিয়ে বাঁধানো রাস্তা ধরে পৌঁছে যাওয়া যায় ঈপ্সিত লক্ষ্যে। আগে ছিল লালমাটির কাঁচা রাস্তা। তারপর শুধুই অবকাশ। ইচ্ছে হলেই হাঁটা যায় বাঁধের রাস্তা ধরে অর্ধবৃত্তাকারে। আর এক পাশে একটু নীচুতে চাষের ক্ষেত। দূরে একপাল গরু চড়ে বেড়াচ্ছে। একটা দুটো করে বক, পানকৌড়ি, মাছরাঙা উড়ে যাচ্ছে-- আবার কখনো একঝাঁক। বকের মত, হাঁসের মত দেখতে আরো কত পাখি। বাঁধের জলে পানকৌড়ির ডুব সাঁতার-- এই আছে, এই নেই।  মাছরাঙা এক জায়গায় স্থির হয়ে বসে ডানা ঝাপটে যাচ্ছে-- মাছ খুঁজছে।

সামনেই মুরাডি পাহাড়, পিছনে বড়ন্তি পাহাড়। দূরে রামচন্দ্রপুর গ্রাম। আরো দূরে ঝাপসা পঞ্চকোট পাহাড় আর বাঁকুড়া জেলার সর্বোচ্চ পাহাড় বিহারীনাথ। বিকেলে পাহাড়ের গায়ে সূর্যাস্ত দেখা সারা জীবন মনে থাকবে। বিকেলের পড়ন্ত আলোয় মুরাডি পাহাড়ের প্রতিচ্ছবি ভাসে বাঁধের জলে। সূয্যিমামা পাহাড়ের বুকে মুখ লুকোনোর আগে ছড়িয়ে দেয় তার রঙের আবির-- আকাশে-বাতাসে-জলে-স্থলে। বাঁধের জল যেন প্রকৃতির এই খেলা দেখার আয়না। চাঁদনি রাতে জলের রুপোলি আভা চোখ ঝলসে দেয়। এই সময় বড়ন্তিতে থাকলে আপনি রোমান্টিকতার স্বর্গে বাস করবেন। 

Baranti Purulia

জীবনপুরের পথিক

বাঁধের রাস্তা ধরে আরো এগোলে একটা ইকো-পয়েন্ট আছে। তারপর সারাদিন গ্রামের পথে পথে ঘোরা তো আছেই। সারাক্ষণ প্রজাপতি উড়ে বেড়ায় ফুলে ফুলে। গ্রামের ঘরগুলি হাতে আঁকা ছবি। এক প্রৌঢ় বসে বসে গনগনে আগুনে ধান সেদ্ধ করছেন-- সেদ্ধ-চাল তৈরি হচ্ছে। একটু এগিয়ে আদিবাসী গ্রাম পেরোলে সামনেই জীবনপুর গ্রাম।বাঁধের কিনারায় লাল শালুক ফুটে আছে, ভাসছে গোলাকৃতি পাতা। এখানেই পাখিদের বেশি ভিড় হয় শীতকালে। জোড়ায় জোড়ায় কত পাখির ভিড়। তাদের মধ্যে লাল ঝুঁটিওয়ালা নীল রঙের দুটি পাখি দৃষ্টি আকর্ষণ করছিলো, কায়েমপাখি। ক্যামেরা হাতে একটু কাছে যেতেই উড়ে গেল। জীবনপুর গ্রাম থেকে আরো এগিয়ে যেতে চাইলে দু-পাশে ধূ ধূ ক্ষেত-- ধানকাটা হয়ে গেছে, দূরে আবছা পাহাড়। পোলট্রি ফার্ম পার হলে তালবেড়িয়া গ্রাম। এখানেও টিলা ঘেরা ছোট ছোট ড্যাম বা জলাধার আছে। আছে পুরোনো শিবমন্দির। খেঁজুর গাছে কলসি বাঁধা রস সংগ্রহ হচ্ছে। পাশেই তালপাতার অস্থায়ী কুঁড়ে। বাঁকুড়া-পুরুলিয়া খেঁজুর আর তালগাছে খুব সমৃদ্ধ।

বড়ন্তিকে কেন্দ্র করে | Baranti Sightseeing

আরো চাইলে যেতে পারেন পাঞ্চেত ড্যাম (Panchet Dam), পঞ্চকোট রাজাদের পরিত্যক্ত রাজধানীর ধ্বংসাবশেষ গড়পঞ্চকোট (Gar Panchkot)। পঞ্চকোট পাহাড়ের পাদদেশে একসময় এখানেই ছিল পঞ্চকোট রাজ্যের সবুজের সংসার।  বিষ্ণুর পঞ্চরত্ন মন্দির ছাড়াও অন্যান্য মন্দির ছড়িয়ে ছিটিয়ে কোনরকমে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। এখান থেকে ঘুরে আসা যায় মাইথনের বাঁধ আর কল্যাণেশ্বরী মন্দির। আর যদি  আদ্রা হয়ে রূপসী বাংলা ধরে ফেরেন তাহলে এর সঙ্গে যুক্ত হতে পারে রঘুনাথপুরে জয়চন্ডী পাহাড় যেখানে সত্যজিৎ রায়ের "হীরক রাজার দেশে" চলচ্চিত্রের শ্যুটিং হয়েছিল। এতকিছুর মধ্যে না গেলে কেবল শুয়ে বসে ফুল-পাখি-প্রজাপতি আর বাঁধের জলের রঙ বদল দেখে অনায়াসে কাটিয়ে দেওয়া যায় দুটোদিন।

Baranti Tour Plan

বড়ন্তি কিভাবে যাবেন | How to reach Baranti.

রাতের হাওড়া-চক্রধরপুর প্যাসেঞ্জার ট্রেনে পরদিন ভোরবেলা আদ্রা পৌঁছে, আদ্রা থেকে লোকাল ট্রেন ধরে মুরাডি। রবিবার ছাড়া লোকাল ট্রেনে বেশ ভিড় হয়। অসুবিধা হলে হোটেলেও বলে রাখতে পারেন গাড়ির জন্য। আদ্রা থেকে মুরাডির দূরত্ব ২১ কিমি। গাড়ি না নিলে মুরাডি থেকে রিক্সা বা ট্রেকারে বড়ন্তির দূরত্ব ৬ কিমি। এছাড়া যে কোন ট্রেন বা বাসে আসানসোল পৌঁছে, আসানসোল থেকে লোকাল ট্রেনে একইভাবে মুরাডি হয়ে বা গাড়িতে সরাসরি বড়ন্তি। আসানসোল থেকে বড়ন্তির দূরত্ব ৩৮ কিমি। ফেরা যেতে পারে আসানসোল থেকে ব্ল্যাক-ডায়মন্ড ধরে বা আদ্রা থেকে রূপসী বাংলায়। এছাড়া লোকাল ট্রেন/বাস তো আছেই।

বড়ন্তি কখন যাবেন | Best time to visit Baranti.

খুব গরমের সময় বাদ দিয়ে যে কোনো সময় যাওয়া যায়। বর্ষাকালে বড়ন্তি সবুজ হয়ে ওঠে আবার বসন্তে একদমই আলাদা রূপ, পলাশের আগুনে রঙিন হয়ে ওঠে বড়ন্তি। শীতেও মনোরম।

কোথায় থাকবেন | Baranti Hotels/ Resort

বেশ অনেকগুলি হোটেল/রিসোর্ট হয়েছে এখন বড়ন্তিতে। 

পলাশবাড়ি ইকো রিসোর্ট, আকাশমনি, মউলবন হিল রিসোর্ট, লেকহিল রিসোর্ট, মনপলাশ, আরণ্যক গেস্ট হাউস, বড়ন্তি ওয়াইল্ড লাইফ এন্ড নেচার স্টাডি হাট, বড়ন্তি ট্যুরিস্ট পয়েন্ট, আঁখিবাড়ি ফ্যামিলি ভিলেজ রিসোর্ট। এইসব হোটেল/রিসোর্ট গুলির নিজস্ব ওয়েবসাইট আছে, নাম লিখে খুঁজলে ফোন নম্বরসহ বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যাবে আর অনলাইনে বুকিংও করা যায়। এগুলো ছাড়াও আরো কিছু থাকার জায়গা রয়েছে।

প্রয়োজনীয় দূরত্ব | Distance Between

  • বড়ন্তি থেকে গড় পঞ্চকোট ১২ কিমি..  Garpanchkot to Baranti 12 k.m.
  • বড়ন্তি থেকে পাঞ্চেত ড্যাম ২৩  কিমি..  Baranti to Panchet dam 23 k.m.
  • বড়ন্তি থেকে বিহারীনাথ ২০ কিমি..  Baranti to Biharinath Hill 20 k.m.
  • বড়ন্তি থেকে জয়চন্ডী পাহাড় ২৭ কিমি..  Joychandi pahar to Baranti  27 k.m.
  • বড়ন্তি থেকে মাইথন ড্যাম ৪০ কিমি..  Baranti to Maithon Dam 40 k.m.
  • বড়ন্তি থেকে কল্যাণেশ্বরী মন্দির ৪১ কিমি। Baranti to Kalyaneshwari Temple 41 k.m.
আরও পড়ুনঃ 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন