লেপচাজগৎ ভ্রমণ বৃত্তান্ত | Lepchajagat an Offbeat Destination in Darjeeling

 
Lepcha Jagat an Offbeat Destination in Darjeeling

মিরিক হয়ে লেপচাজগৎ | lepchajagat via Mirik

পাহাড়-জঙ্গলে ঘেরা উত্তরবঙ্গের একটি ছোট গ্রাম লেপচাজগৎ। দার্জিলিং থেকে দূরত্ব মাত্র ১৯ কিমি। এখন অনেক পর্যটকেরই পছন্দ দার্জিলিংয়ের ভিড় এড়িয়ে নিরিবিলিতে লেপচাজগৎ-এ থেকে দার্জিলিং ঘুরে আসা। তবে লেপচাজগৎ ছোট জায়গা বলে সেই তুলনায় থাকার জায়গা কম। কার্শিয়াং-এর দিক থেকে টুং, সোনাদা, ঘুম পেরিয়ে পৌঁছে যাওয়া যায় লেপচাজগৎ। আবার মিরিক, সুখিয়ার দিক দিয়েও পৌঁছনো যায় লেপচাজগৎ। আমার মিরিকের পথটা বেশি পছন্দ। পথে পড়বে গোপালধারা টি এস্টেট। অপূর্ব প্রাকৃতিক শোভা। সবুজে সবুজ চা-বাগানের মধ্যে দিয়ে আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে এই সফর। যেন কোন শিল্পীর তুলিতে আঁকা দৃশ্যপট।   

তাবাকোশি

আমরা যে জিপে ছিলাম ওই জিপে একজন সরকারি কর্মচারি ছিলেন, ওনার কিছু কাজ ছিল তাবাকোশির দিকে। মিরিক থেকে ৬ কিমি ভেতরে প্রায় ৩৫ মিনিটের পথ। গোপালধারা চা-বাগিচার মধ্যেই এক নতুন অফবিট গন্তব্য তাবাকোশি। মিরিক, তাবাকোশি হয়ে সুখিয়া পৌঁছতে একটু দেরি হলেও এপথের নৈসর্গিক শোভা মন-প্রাণ ভরিয়ে দিল। তাবাকোশিতেও হোম-স্টে হয়েছে এখন। তাবাকোশি এখন প্রায় একদমই আনকোরা (offbeat-destination)। এখানে থেকে ইচ্ছেমতো পায়ে হেঁটে ঘুরে বেড়ানো যায় চা-বাগানের মধ্যে দিয়ে। তাবাকোশির আর এক আকর্ষণ রংভং নদী। এখানে নদীর ধারে তাঁবুতেও থাকার ব্যবস্থা আছে। পাহাড়, নদী, চা-বাগান--এত কিছু একসাথে! কোন এক পূর্ণিমা রাতে রংভং নদীর তীরে তাবাকোশিতে থাকার ইচ্ছে রইল। এডভেঞ্চার প্রিয় এবং নির্জনতা প্রিয় মানুষদের জন্য নিঃসন্দেহে একেবারে হটস্পট এই তাবাকোশি। 

আরও পড়ুনঃ 

দার্জিলিং অফবিট ডেস্টিনেশন লামাহাট্টা-তিনচুলে

লেপচাজগৎকে ঘিরে | lepchajagat Sightseeing .

সুখিয়া থেকে মাত্র ২ কিমি দুরেই জোড়পোখরি। জোড়পোখরি ঘুরেও লেপচাজগৎ যাওয়া যায়, আবার পরে লেপচাজগৎ থেকেও জোড়পোখরি ঘুরে নেওয়া যায়, কাছেই। সুখিয়া থেকে লেপচাজগৎ ৩ কিমি। অন্য আরো একটি রাস্তা চলে গেছে মানেভঞ্জনের দিকে। লেপচাজগৎ থেকে দার্জিলিং, 

কার্শিয়াংও ঘুরে নেওয়া যায়। হাতে একটু সময় থাকলে ঘুম চলে গিয়ে, টয়ট্রেনে চেপে কার্শিয়াং থেকে ঘুরে আসা যায়। কার্শিয়াংও আমার উত্তরবঙ্গের প্রিয় জায়গাগুলোর মধ্যে একটি। অন্যান্য জায়গাগুলোর মতো কার্শিয়াং কিন্তু এখনো সে অর্থে পর্যটক মহলে ততটাও জনপ্রিয় নয়। কার্শিয়াং-এ আগে দু-দিন ছিলাম। কেমন জানলা দিয়ে ঘরের ভেতরে মেঘ ঢুকে আসত! লেপচাজগৎও মেঘেদের আরেক খেলাঘর। সবই তো কাছাকাছি জায়গা, আর মেঘেদের তো অবাধ স্বাধীনতা। 

হোমস্টেগুলি লেপচা পরিবার দ্বারা পরিচালিত | HomeStay/Hotels at Lepcha Jagat.

লেপচাজগৎ-এ প্রায় সবই হোমস্টে (Home Stay), লেপচা পরিবার দ্বারা পরিচালিত। ঘুম থেকে সুখিয়া যাওয়ার পথের ওপরই লেপচাজগৎ। ওদিকের পাহাড়ে দার্জিলিংয়ের ঘর-বাড়ি। সলাখা, কাঞ্চনকন্যা হোমস্টেগুলো একদম রাস্তার ধারেই, সামনে দিয়ে জিপ/বাস যাচ্ছে। তবুও বেশ নির্জন। অদ্ভুত একটা মাদকতা আছে এই লেপচাজগৎ-এর। যেমনটা ঠিক এখানকার মানুষগুলোর। একটু ভেতরে থাকতে চাইলে পাখরিন হোমস্টে বা পশ্চিমবঙ্গ বন উন্নয়ন নিগমের বাংলো ভালো। অসংখ্য রডোডেনড্রন, ক্যামেলিয়া, সাদা ও গোলাপি রঙের ম্যাগনোলিয়া, পাইন বন ঘিরে রেখেছে বাংলটিকে। এখানে লাল রডোডেনড্রনের আধিক্য বেশি, লালি গুঁড়াস। আমরা সলাখাতে ছিলাম। ফুটফুটে একটা চারমাসের বাচ্চা এই হোমস্টের মূল আকর্ষণ। তার সাথে ওই পরিবারের সবার উষ্ণ আতিথেয়তা। শুধু এই হোমস্টেই নয় সব হোমস্টেগুলোই খুব আন্তরিক শুনেছি অন্য বন্ধুদের থেকে যারা থেকে গেছেন। যেখানেই থাকুন ঘুরে আসা যায় বনদপ্তরের বাংলোর চৌহদ্দি থেকে।

মেঘেদের খেলাঘর

লেপচাজগৎ-এর উচ্চতা ৭,০০০ ফুট। লেপচাজগৎ জুড়ে ধুপী বনের আধিক্য। পথের দু-ধারে ওক-পাইন-ধুপী গাছের জঙ্গল। কিছু বিরল প্রজাতির পাখি ও অর্কিড দেখতে পাওয়া যায় এই অঞ্চলে। পাখি দেখার সেরা সময় মার্চ মাস। রোজ সকালে পরিস্কার আকাশ ঝলমলে রোদ্দুর কিন্তু বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় মেঘেদের আনাগোনা; রোদ-মেঘের লুকোচুরি খেলা। কয়েক পশলা বৃষ্টি আবার খিলখিলিয়ে রোদ্দুর উঠে যায়। দুপুরবেলা ঘন কুয়াশায় ঢেকে যায় গাছপালাগুলো-- ঠিক যেন কোন ভুতুড়ে সিনেমার শ্যুটিং স্পট! 

 পাহাড় মানে শুধুই স্নো-রেঞ্জ নয় | Kanchenjunga from Lepchajagat.

হালকা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে কিছুটা হাঁটা পথে পৌঁছে যাওয়া যায় লেপচাজগৎ ভিউ-পয়েন্ট, একটু ওপরে একটা ফাঁকা জায়গায় বসার জায়গা, দোলনা সবই আছে। কিছু হোমস্টের ছাদ বা বারান্দা থেকেও কাঞ্চনজঙ্ঘার দেখা পাওয়া যায়। আবহাওয়া ভালো থাকলে সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত দুই-ই বেশ উপভোগ্য। কিন্তু কাঞ্চনজঙ্ঘা মেঘের আড়ালে মুখ লুকোলেও লেপচাজগৎ-এর মাধুর্য্য কিছু কম নয়। যে কোন পাহাড়ি জায়গা থেকে স্নো-রেঞ্জ দেখতে পাওয়ার একটা বাসনা থাকেই। তবে হিমালয়ান-ভিউ বা পাহাড় মানে শুধুই স্নো-রেঞ্জ নয়। গাছ ভর্তি লাল রডোডেনড্রন, সাদা-গোলাপি ম্যাগনোলিয়া ফুল, তাতে পাহাড়ি পাখি-প্রজাপতির সারাক্ষণ আসা যাওয়া; এতো সবুজ; হু হু করে মেঘেদের আসা-যাওয়া; কুয়াশার বুক চিরে গাড়ির ছুটে চলা; পাহাড়ের খাঁজে গাছেদের ফাঁকে জমাট বাঁধা কুয়াশা; এক পশলা বৃষ্টির পর পাহাড়ের গায়ে কচি রোদ্দুরের লুটোপুটি; বিকেলের পর দার্জিলিংয়ের আলো ঝলমলে রূপ; সন্ধ্যাবেলার মোমো-কফি এইসব কিছু নিয়েই তো পাহাড়, হিমালয়। 

ঘুরে আসা যায় দার্জিলিং, জোড়পোখরি থেকে

পরদিন কয়েকজন পর্যটক একটা গাড়ি নিয়ে দার্জিলিং ঘুরতে গেলেন-- হিমালয়ান-মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউট,  গঙ্গা-মাইয়া পার্ক, রক-গার্ডেন,  চিড়িয়াখানা,, বাতাসিয়া লুপ, ঘুম মনাস্ট্রি, ম্যাল ইত্যাদি। আমরা গেলাম জোড়পোখরি, আবহাওয়া ভালো থাকলে এখান থেকেও কাঞ্চনজঙ্ঘার দৃশ্য দারুণ লাগে।জোড়পোখরিতে দার্জিলিং গোর্খা হিল কাউন্সিলের একটা সুন্দর সাজানো বাংলো আছে, এখানে একদিন থাকতে পারলে খুব ভালো হয়। জোড়পোখরি জলাশয়ে প্রচুর হাঁস দেখা যায়। এলাকাজুড়ে পাইন-ধুপীর জঙ্গল। জলাশয় থেকে কৃত্রিম সাপের ফণা উঠেছে। সব কিছু মিলিয়ে বেশ দৃষ্টিনন্দন। কোথাও না গিয়ে ফুল, পাখি আর মেঘ দেখেই কেটে যায় দুটো দিন।

Lepcha Jagat an Offbeat Destination in Darjeeling


কিভাবে যাবেন | How to visit Lepchajagat.

হাওড়া বা শিয়ালদহ থেকে যে কোনও ট্রেনে নিউ জলপাইগুড়ি অথবা বাসে শিলিগুড়ি, বিমানে  বাগডোগরা। এরপর শেয়ার বা ভাড়া গাড়িতে লেপচাজগৎ। সরাসরি শেয়ার জিপ না পেলে ঘুম/সুখিয়া নেমে, ঘুম/সুখিয়া থেকে অন্য গাড়িতে লেপচাজগৎ। শিলিগুড়ির দার্জিলিং-মোড় থেকে সুখিয়ার শেয়ার জিপ ছাড়ে। শুধু লেপচাজগৎ গেলে যাতায়াত নিয়ে চারদিন যথেষ্ট। এর সাথে আরো দু-তিনদিন জুড়ে নিলে তাকদা-তিনচুলে-লামহাট্টা ঘুরে নেওয়া যায়।

কখন যাবেন | Best time to visit Lepcha Jagat.

ফুল, পাখি দেখার জন্য বসন্ত সেরা সময়। নাহলে শীতকালে আবহাওয়া ভালো থাকে, আকাশ পরিস্কার থাকে। অক্টোবর থেকে এপ্রিল লেপচাজগৎ ঘোরার উপযুক্ত সময়। 

কোথায় থাকবেন | Home Stay Lepchajagat.

পশ্চিমবঙ্গ বন উন্নয়ন নিগমের বাংলো, পাখরিন হোমস্টে, গ্রিনভ্যালি হোমস্টে, সলাখা হোমস্টে, কাঞ্চনকন্যা 

হোমস্টে ইত্যাদি এরকম আরো কিছু বেসরকারি হোমস্টে আছে। থাকা-খাওয়া মিলিয়ে প্রতিদিন-জনপ্রতি ৮০০-১,০০০ টাকা করে। 

প্রয়োজনীয় দূরত্ব | Distance between

নিউ-জলপাইগুড়ি থেকে মিরিকের দিক দিয়ে লেপচাজগৎ গেলে ৮০ কিমি; NJP to Lepchajagat via Mirik 80 km. 

  • ঘুমের দিক দিয়ে গেলে ৭৪ কিমি; Lepcha Jagat via Ghoom 74 km.
  • নিউ-জলপাইগুড়ি থেকে মিরিক ৫৩ কিমি; NJP to Mirik 53 km.
  • মিরিক থেকে লেপচাজগৎ ২৭ কিমি; Mirik to Lepchajagat 27 km.
  • নিউ-জলপাইগুড়ি থেকে ঘুম ৬৭ কিমি; NJP to Ghum 67 km.
  • ঘুম থেকে লেপচাজগৎ ৭ কিমি;  Lepchajagat to Ghoom 7 km.
  • দার্জিলিং থেকে লেপচাজগৎ ১৯ কিমি;  lepchajagat to darjeeling 19 km.
  • সুখিয়া থেকে লেপচাজগৎ ৩  কিমি; Lepchajagat to Sukhia 3km.
  • লেপচাজগৎ থেকে জোড়পোখরি ৫ কিমি | Lepchajagat to Jorpokhri 5 km.

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন