বিকেলের কেদারনাথ |
দেবভূমির প্রবেশদ্বার হরিদ্বার |কেদারনাথ ভ্রমণ গাইড ।
হরিদ্বার মানেই আমার কাছে দুন-এক্সপ্রেস। আমাদের বাড়ি স্টেশনের কাছেই। শ্রীরামপুর স্টেশনে দুন-এক্সপ্রেস দাঁড়ায়। রাতে খেয়ে দেয়ে বাড়ির সামনে থেকে দূরপাল্লার ট্রেনে ওঠার মজাই আলাদা! দ্বিতীয় দিনটা কাটিয়ে তৃতীয় দিন ভোর ভোর হরিদ্বার। কয়েকঘন্টা দেরী করলেও কোনো সমস্যা নেই, পৌঁছনোর দিনটা হরিদ্বারেই থাকি যখনই এপথে যাই। আরতি দেখে, রাবড়ি- লস্যি , কচুড়ি, মাসির হোটেলে দুবেলা পাত পেড়ে খেয়েও অনেকটা সময়। আমরা বারে বারে টুকটাক এদিক ওদিক করে হরিদ্বারের দর্শনীয় স্থানগুলি দেখে নিয়েছি ।
আরও পড়ুনঃ দাওয়াইপানি মিনারেল স্প্রিং ভিলেজ, উত্তরবঙ্গ দার্জিলিং
একবার হেঁটে মনসা পাহাড় উঠেছিলাম। দু-বার রোপওয়ে করে চন্ডী পাহাড় গিয়েছিলাম। আরো কিছু মন্দির , আশ্রম দেখে নেওয়া যায়। তবে গঙ্গা-আরতি দেখে দেখে যেন আশ মেটে না। পরদিন সকাল সকাল যেখানে ইচ্ছে যাওয়া যায়। এখান থেকে গঙ্গা মর্ত্যে অবতরণ করেছেন আর আমাদের জন্য দেবভূমির দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে। এই উত্তরাখণ্ডের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেই কাটিয়ে দেওয়া যায় সারাজীবন। হরিদ্বার থেকে হৃষিকেশও ঘুরে নেওয়া যায়। আবার ঋষিকেশের শান্ত পরিবেশে থেকে আড়ম্বরহীন গঙ্গা-আরতি দেখতেও বেশ লাগে। হরিদ্বারের তুলনায় হৃষিকেশ থেকে দূরগামী বাস-জিপের উপায় অনেক বেশি। বাসস্ট্যান্ডটাও বেশ বড়ো।
এবার হরিদ্বার স্টেশন নেমেই প্রথম কাজ বায়োমেট্রিক-রেজিস্ট্রেশন কার্ড সংগ্রহ করা। চারধাম যাত্রার জন্য যা এখন বাধ্যতামূলক। বেশ ফাঁকায় ফাঁকায় কাজ সারা হয়েগেল। স্টেশনেই জলখাবার সেরে ছুটলাম বাসস্ট্যান্ডে। GMOU এর কাউন্টার থেকে আগামীকাল সকাল ৭ টায় শোনপ্রয়াগ যাওয়ার জন্য আগাম টিকিট কেটে নিলাম। হরিদ্বার থেকে শোনপ্রয়াগের দূরত্ব প্রায় ২৩১ কিমি। বাস ভাড়া জনপ্রতি ৩০০ টাকা। GMOU ছাড়াও বিশ্বনাথ সেবা, নন্দাদেবী এক্সপ্রেসের বাসও যায় এপথে। চাইলে বাসস্ট্যান্ডের কাছেই কোনো হোটেলে থেকে যাওয়া যায়। তবে আমার মনে হয় হরিদ্বারে যতটুকুই থাকি ওই হর-কি-পৌরি ঘাটের কাছাকাছিই কোথাও থাকি। অটো করে সকালে আবার চলে আসবো নাহয় বাসস্ট্যান্ডে ।
বিবিধের মাঝে
সকাল ৭ টার GMOU-এর বাসে আমরা তিনজন ছাড়া দুজন বাঙালি চলেছেন কেদারনাথ দর্শনে। আর বাস ভর্তি কর্ণাটক থেকে আগত যাত্রী। ওনারা কন্নড় ভাষায় কথা বলছেন, আমরা কিছুই বুঝতে পারছি না। ওনাদের মধ্যে একটি ছেলে হিন্দি-ইংলিশ কিছুটা তাও বোঝে কাজ চালিয়ে নেওয়ার মতো। কথা বলে জানতে পারলাম ওনারা শুধু কেদারনাথের নাম শুনেই চলে এসেছেন। কেদারনাথের ঠান্ডা, উচ্চতা, কতটা হাঁটতে হবে এসব কিছুই জানা নেই। দলে বেশ কয়েকজন বয়স্ক মানুষ, বাচ্চা। কোনো শীতবস্ত্র সঙ্গে আনেনি কেউ, জুতো ও দেখলাম পা ঢাকা নয়। ওনাদের বোঝানোর চেষ্টা করলাম, এখন ওখানে মেঘলা-বৃষ্টি-তুষারপাত হয়ে চলেছে প্রায় রোজই। তাই উপযুক্ত গরম জামা ছাড়া এমন কোলের বাচ্চা, বয়স্ক মানুষকে নিয়ে যাওয়া উচিত নয় ।
আরো পড়ুনঃ
হরিদ্বার থেকে উত্তরকাশী, হর্ষিল হয়ে গঙ্গোত্রী ভ্রমণ
কুমায়ুন ভ্রমণ পরিকল্পনা | Kumaon Budget Tour Plan
দেবপ্রয়াগ, রুদ্রপ্রয়াগ, গুপ্তকাশী হয়ে শোনপ্রয়াগ | Sonprayag via Devprayag, Rudraprayag, Guptkashi
বাস খুব সাধারণ মানের। তবে ভালোই যাচ্ছে। দলে ৫-৭ জন থাকলে একটা গাড়ি ভাড়া করে নেওয়া সব থেকে ভালো। হরিদ্বার থেকে দেবপ্রয়াগ , শ্রীনগর হয়ে রুদ্রপ্রয়াগ ১৬৩ কিমি (163 km)। স্বর্গের নদী মন্দাকিনী অলকানন্দার সঙ্গে মিলিত হয় এই রুদ্রপ্রয়াগে। এখান থেকেই রাস্তা ভাগ হয়েছে কেদারনাথ ও বদ্রীনাথের। বদ্রীনাথের পথে অলকানন্দা সঙ্গী আর কেদারনাথের পথের সঙ্গী মন্দাকিনী। রুদ্রপ্রয়াগ থেকে ৪০ কিমি গিয়ে গুপ্তকাশী। ৪,৫০০ ফুট উচ্চতায় গুপ্তকাশীতে আছে শিবের বিখ্যাত অর্ধনারীশ্বর মূর্তি। জ্ঞাতি হত্যার পাপ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য যখন পাণ্ডবরা শিবের খোঁজে বেরিয়ে পড়েন, তখন শিব নিজেকে লুকিয়ে রাখেন এখানে।
পরিস্কার আকাশে গুপ্তকাশী থেকে হিমালয়ের অন্যতম সুন্দর শিখর চৌখাম্বার শোভা মুগ্ধ করে। গুপ্তকাশী থেকে ফাটা , সীতাপুর হয়ে শোনপ্রয়াগ ২৮ কিমি। সীতাপুরে যে নতুন থাকার জায়গাগুলো হয়েছে তা বেশ আকর্ষণীয় মনে হল। শোনপ্রয়াগের মাত্র ২ কিমি আগে সীতাপুর। শোনপ্রয়াগে এসে শোনগঙ্গা হারিয়ে যায় মন্দাকিনীতে। হরিদ্বার থেকে টানা বাসে শোনপ্রয়াগ পৌঁছতে সময় লাগে প্রায় ১০ ঘন্টা। আমাদের হরিদ্বার স্টেশন থেকেই বায়োমেট্রিক-রেজিস্ট্রেশন করানো হয়ে গেছে বলে শোনপ্রয়াগে না থেকে উত্তাল মন্দাকিনীকে ডানদিকে রেখে এগিয়ে যাই গৌরীকুন্ডের পথে। আগে সরাসরি গৌরীকুন্ড অবধি বাস চলে যেত। এখন নতুন পথ হওয়ার পর শোনপ্রয়াগ অবধি বাস যায় । তারপর বাকি ৫ কিমি ছোট শেয়ার গাড়িতে যেতে হয়, ভাড়া জন প্রতি পঞ্চাশ টাকা। নীচে তাকিয়ে দেখলাম শোনপ্রয়াগের বিশাল জিপ স্ট্যান্ড-এ গিজগিজ করছে গাড়ি।
গৌরীকুণ্ডে একরাত | Gaurikund
গৌরীকুন্ড পৌঁছতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। শোনপ্রয়াগ গৌরীকুন্ড, কোথাও তিল ধারণের জায়গা নেই । ভাবতে পারিনি এবার মে মাসের দ্বিতীয়/তৃতীয় সপ্তাহে এত্ত ভিড়! ভিড় সামলাতে পুলিশ, সাহায্যকর্মীরা সব হিমশিম খাচ্ছেন। তারওপর মেঘলা বৃষ্টির জন্য আজ হেলিকপ্টার সার্ভিস বন্ধ। তাই গৌরীকুণ্ডে ভিড় উপচে পরছে। সবাই চাইছেন ঘোড়া , পিঠহু অথবা ডান্ডিতে গিয়ে দর্শন করে আসবেন। হেলিকপ্টার সার্ভিস নিয়মিত চললে অনেক দর্শনার্থীই ফাটায় থেকে যান, সেক্ষেত্রে ফাটা থেকেই বায়োমেট্রিক রেজিস্ট্রেশন করিয়ে নেওয়া যায়। হেলিকপ্টারে কেদারনাথ দর্শনের জন্য পবন-হংস থেকে অনলাইনে বুকিং পাওয়া যায়। যাওয়া-আসা মিলিয়ে জন প্রতি ৮,০০০ টাকা। সময় বিশেষ এ দর ওঠা নামা ও করে । সেক্ষেত্রে বেলা দশ-টার উড়ানে কেদারনাথ পৌঁছে রাতটা কেদারনাথে কাটিয়ে পরদিন সকাল ছ-টার উড়ানে আবার ফাটা নেমে আসা যায়। আবার অনেকেই দর্শন করে দিনে দিনেই ফিরে আসেন। অগস্ত্যমুনি থেকেও কেদারনাথের হেলিকপ্টার সার্ভিস আছে। সেক্ষেত্রে ভাড়া আরো বেশি।
অনেক খোঁজাখুঁজির পর গৌরীকুণ্ডে একটা থাকার জায়গা পেলাম বেশ চড়া দামে। কিন্তু একসময় মনে হচ্ছিল থাকার জায়গা না পেলে কি করবো ! গৌরীকুণ্ডে গাড়োয়াল মন্ডল বিকাশ নিগমের লজও আছে, আগে থেকে অনলাইনে বুকিং করে নেওয়া যায় । গৌরীকুন্ড জায়গাটি খুব ছোট্ট আর ঘিঞ্জি। উচ্চতা ৬৫০০ ফুট। পুরাণ মতে, হিমালয় দুহিতা দেবী গৌরী শিবকে পতিরূপে পেতে এখানেই তপস্যা করেন। কেদারনাথের পথে হাঁটা শুরু এই গৌরীকুন্ড থেকেই। গৌরীকুন্ডের অন্যতম আকর্ষণ গরমজলের কুন্ডটির অস্তিত্ব এখনও আছে কিন্তু আগের মতো সুন্দর বাঁধানো ঘাট আর নেই।
খুব ভোরে অন্ধকার থাকতেই ঘুম থেকে উঠে প্রস্তুত হয়ে নিই কেদারনাথ যাত্রার উদ্দেশ্যে। ঘরের বাইরে বেরিয়ে দেখি ঝিরঝির করে বৃষ্টি হচ্ছে , বেশ মেঘলা আবহাওয়া। কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস একটা ব্যাগে গুছিয়ে নিয়ে নিয়েছি গতকাল রাতেই। বাকি মালপত্র গৌরীকুন্ডের ক্লোকরুমে রেখে সামনে এগিয়ে যাই।
ভোর হতেই হাঁটা শুরু
কিছুটা গিয়েই ঘোড়া স্ট্যান্ড। এখান থেকেই ঘোড়া ভাড়া পাওয়া যায়। এছাড়া সারা পথেই যখন ইচ্ছে ঘোড়া, পিটহু, ডান্ডি নেওয়া যায়। তবে ঘোড়া এখন কেদারনাথ বেসক্যাম্প পর্য্ন্ত যায়, মন্দিরের দেড় কিমি আগে পর্যন্ত । তারপর ঐটুকু পথ হেঁটেই যেতে হবে। খুব অসুবিধা হলে পিঠহু পাবেন, মানে ঝুড়িতে বসিয়ে পিঠে করে নিয়ে যায়। হাঁটতে পারলে হেঁটে যাওয়াই সব থেকে ভালো। কেদারনাথের আগের পথের তুলনায় দূরত্ব ও চড়াই দুটোই বেড়েছে। তবু প্রকৃতিকে উপভোগ করতে চাইলে হেঁটে যাওয়াই শ্রেয়। চওড়া , বাঁধানো পথ। খাদের দিকে রেলিং দেওয়া। সারা পথেই খাবারের দোকান, বিশ্রামের জায়গা, পানীয় জলের ব্যবস্থা, বাথরুম সবই আছে। শুধু পদাতিকদের বিড়ম্বনা ঘোড়া, ডান্ডিদের হই হই করে ঘাড়ের সামনে চলে আসা। জড়োসড়ো হয়ে পথ ছেড়ে দিতে হবে তাদের। বৃষ্টি হয়েই চলেছে সমানে। হাঁটা শুরু থেকে যে বৃষ্টি হচ্ছে তা একবারের জন্যও থামেনি। বৃষ্টির জলে, ঘোড়ার বর্জ্য পদার্থে রাস্তা বেশ কর্দমাক্ত, পিচ্ছিল। ধীরে ধীরে সাবধানে এগিয়ে চলেছি।
পথে দেখা হল সেই কর্ণাটক থেকে আসা বাসযাত্রী দুজনের সাথে। ছেলেটি আর তার বাবা বাকিদের নীচে রেখে কোনো রকমে গায়ে চট আর প্লাস্টিক জড়িয়ে দর্শন করতে যাচ্ছেন। ছোট কোলের শিশু থেকে বয়স্ক মানুষ সবাই চলেছেন-- বিশ্বাস , ভক্তি মানুষের মনোবল, শারীরিক সামর্থ্য অনেক বাড়িয়ে দেয়। এনাদের দেখে এমন দুর্গম পথে বৃষ্টি মাথায় করে হাঁটার উৎসাহ আরো বেড়ে যায়। বার বার প্রমাণ হয় বিশ্বাসে মিলায় বস্তু!
গৌরীকুন্ড থেকে লিঞ্চলি | Gaurikund to Lincholi
গৌরীকুন্ড থেকে জঙ্গলচটি ৫ কিমি। আরো ১কিমি গিয়ে ভীমবালি। ভীমবালিতে গাড়োযাল মন্ডল বিকাশ নিগম (GMVN)- এর থাকার ব্যবস্থা আছে। চলার পথে সর্বক্ষণের সঙ্গী মন্দাকিনী নদী, পাহাড়ের গা বেয়ে ঝরণা, সবুজ পাহাড় আর প্রকৃতি। চড়াই ভাঙতে শ্বাসকষ্ট হলে কর্পূরের গন্ধে কিছুটা আরাম হয় । এছাড়াও সঙ্গে রাখতে পারেন coca-6 হোমিওপ্যাথি ওষুধ। আরো ১ কিমি এগিয়ে রামওয়াড়া চটি। পুরোপুরি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। ২০১৩ সালের ১৬ ই জুনের ধ্বংসলীলার সাক্ষী এখনও ছড়িয়ে আছে চারদিকে। প্রকৃতির সেই রুদ্র রূপের কথা ভাবলেই কেমন লাগে !
জায়গায় জায়গায় এরপর শুরু হল দু-দিকে বরফের প্রাচীর। রামওয়াড়া থেকে লিঞ্চলি ৪ কিমি। অর্থাৎ গৌরীকুন্ড থেকে লিঞ্চলির দূরত্ব ১১ কিমি। বৃষ্টির দাপট বেশ বেড়ে চলেছে। আমরা ঠিক করেই এসেছিলাম একটানা কেদারনাথ না গিয়ে আজ লিঞ্চলিতে থাকবো। এত বৃষ্টিতে আর এগোনো সম্ভবও নয়। জুতো-মোজা জামা প্রায় সব ভিজে গেছে । যতই বর্ষাতি থাক সেই সকাল থেকে একটানা বৃষ্টির মধ্যে হাঁটছি। লিঞ্চলিতে GMVN-এর থাকার জায়গা আছে। তবে একটা ঘরে ৭জন। ৭ জনের দল না থাকলে অন্যদের সাথে ঘর শেয়ার করতে হবে। ঘরে দুটো বাথরুম , গিজার সবই আছে। ব্যবস্থা ভালোই। জন প্রতি থাকার খরচ ৭০০-৯০০ টাকা। এছাড়া কম খরচে টেন্ট-এও থাকা যায়,জনপ্রতি ২০০-৩০০ টাকা। একটানা বৃষ্টির আওয়াজ আর তার সাথে ঘোড়া যাওয়ার টুংটাং শব্দ হয়েই চলেছে। এই আওয়াজটা হাঁটার সময় যতটা বিরক্তিকর লাগছিল এখন ততটাই ভালো লাগছে। এই দুর্যোগের মধ্যে কেমন যেন প্রাণের স্পন্দন। বহু মানুষ লিঞ্চলিতে থাকতে বাধ্য হলেন, জায়গা না পেয়ে অনেকেই এই দুর্যোগ মাথায় নিয়ে এগিয়ে যেতে বাধ্য হলেন। সন্ধ্যা নাগাদ বৃষ্টি থেমে আকাশ পরিস্কার হয়ে গেল।
kedarnath helipad |
পথের সঙ্গী কেদারশৃঙ্গ
সকালে ঘুম ভেঙে দেখি ভোরের আলো ফোটেনি ভালো করে। তারমধ্যেই কেদারশৃঙ্গের দেখা পেলাম এই প্রথম। একদম নির্মেঘ আকাশ। সূর্যোদয়ে রক্তিম আভা ধারণ করেছে তুষারাবৃত গিরিশিখর। মৌন-গম্ভীর শান্ত পরিবেশ। গতকালের সব গ্লানি চিন্তা ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেল। ঝকঝকে নীল আকাশ, রোদ্দুর উঠেছে। নতুন উদ্যমে এগিয়ে চলি। একটা দুটো রোজফিঞ্চ পাখি চোখে পড়লো , বাংলা নাম জানিনা। ছবি তোলার চেষ্টা করলাম। একটা ছোট্ট মিষ্টি হলুদ পাখি দেখলাম পাহাড়ি পাখি কিন্তু নাম জানিনা । ওই রোজফিঞ্চ পাখিটার সঙ্গী কি ? কে জানে ! আমি পাখি ভালো চিনিনা। অনেক পাখি এপথে । ভাগ্য ভালো হলে মোনালের দেখাও পাওয়া যায়। লিঞ্চলি থেকে কেদারনাথ ৫ কিমি । এখান থেকে পুরো পথের সঙ্গী কেদারশৃঙ্গ। দুদিকের বরফ-প্রাচীরের মাঝখান দিয়ে উঁকি দিচ্ছে কেদারশৃঙ্গ।
একেই রাস্তা সরু তারওপর একদিক দিয়ে ঘোড়া উঠছে , একদিক দিয়ে নামছে মাঝে স্যান্ডউইচ আমরা! ঘোড়ায় ঘোড়ায় রাস্তা আটকে যাচ্ছে। হাঁটাই দুষ্কর। অনেক সময়ও নষ্ট হচ্ছে এইজন্য। ঘোড়াওয়ালাদের হন্তদন্তের জন্য পথের শোভা-উপভোগে বেশ বাধার সৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু কি আর করা যাবে , যে পথের যা দস্তুর। কোথাও কোথাও ঘোড়ায় চলা পথ আর মানুষের চলার পথে আলাদা । কি শান্তি যে লাগছিল ! হেঁটেও শান্তি । যদি এমনটাই পুরো করে দেয় খুব ভালো হয় । তবে এখন অতিরিক্ত ভিড় বলেই এই সমস্যা, অন্যসময় এলে এত অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
ধীরে ধীরে প্রকাশ পাচ্ছে রক-টাওয়ার, ভাতরেকুন্থ শিখররাজি। ঝকঝকে রজতশুভ্র রূপে চোখ ঝলসে যাচ্ছে। আজ প্রকৃতির রূপ অসাধারণ! গতকালের বৃষ্টিতে ভিজে এতটা পথ আসা যেন সার্থক মনে হচ্ছে।
কেদারনাথ বেস-ক্যাম্প | Kedarnath Base Camp
বেসক্যাম্পেই কিছুক্ষণের চা-ম্যাগি বিরতি। সামনেই আকাশজোড়া মহামহিমের স্বর্গীয় উদ্ভাস! সুমেরু পর্বতের কোলে সুন্দরতম কেদার, কেদারনাথ। সামনেই ডানদিকে একটা ছোট কুন্ড জমে বরফ। গত কয়েকদিন ধরেই তুষারপাত হওয়ার জন্য আশেপাশে বরফ জমে আছে। কুন্ডটির নাম নাকি গুগগল কুন্ড। অন্যসময় কুন্ডের জলে কেদারশৃঙ্গের প্রতিবিম্ব দেখা যায়, কিন্তু এখন বরফের জন্য তা আর সম্ভব নয়। তবে বরফে মোড়া এই দৃশ্যও অতুলনীয়। বরফ , রোদ্দুর , সবুজ পাহাড়, নীল আকাশ , তুষারশৃঙ্গ সব মিলিয়ে চোখ ঝলসানো শোভা। সবকিছুর মাঝে স্ব-মহিমায় ভাস্বর কেদারনাথ মন্দির। আজ আবহাওয়া পরিস্কার থাকার জন্য হেলিকপ্টার সার্ভিসও চালু হয়েছে। আসা-যাওয়া লেগেই আছে। নীল আকাশ আর সবুজ পাহাড়ের বুকে রঙিন ছোট ছোট উড়ানগুলি দেখতে বেশ লাগছে। হেলিপ্যাড থেকে কিছুটা এগিয়ে GMVN-এর থাকার জায়গা স্বর্গারোহিনী । এখান থেকে আধকিমি হেঁটে যেতে হয় মন্দির চত্বরে।
পৌঁছে গেছি! |
মন্দিরকে ঘিরে থাকার জায়গা | Hotels at Kedarnath Temple.
আমরা আরো এগিয়ে যাই মন্দিরের কাছে। এখানেই বেশ কিছু বেসরকারি থাকার জায়গা আছে মন্দিরের আশেপাশেই। আজও অনেক খোঁজাখুঁজির পর একটা থাকার জায়গা পেলাম। এই ভিড়ের সময়টা ছাড়া অর্থাৎ মে-জুন আর পুজোর সময় বাদ দিয়ে অন্য সময় এলে যেমন জুলাই, আগস্ট, সেপ্টেম্বর বা পুজোর পর এলে, থাকার জায়গা কিন্তু সহজেই পাওয়া যাবে এবং এখনকার তুলনায় অনেকটাই কম দামে। বেসরকারি হোটেলে ৭০০-৮০০ টাকার মধ্যেই থাকার জায়গা পাওয়া যায়। মন্দির চত্বরে পৌঁছে এক অন্যরকম অনুভূতি হয়। এই যে এতটা পথ এসে পৌঁছেছি , এতেই আমার কেদারনাথ দর্শন হয়ে গেছে মনে হচ্ছে। মনে হয় সারাক্ষণ এখানেই বসে থাকি।
বিকেলবেলা আবার হালকা তুষারপাত হয়। তুষারপাতের পর নরম রোদ্দুরের উষ্ণতা বড়ো আরাম দেয়। ভিড়ের সময় দর্শনের জন্য পরচি সংগ্রহ করতে হয় , পরচি অনুসারে পর পর সংখ্যা ঘোষণা করা হয়। আমরা গেটের সামনে থেকে টিকিট নিয়ে এলাম। সূর্যাস্তের সময় প্রকৃতির রঙে রঙিন হয়ে উঠলো কেদারশৃঙ্গ, তারপর জ্বলে উঠলো মন্দিরের আলো-- শুরু হল সন্ধ্যারতি। সবাইমিলে মেতে উঠলাম "জয় কেদার" ধ্বনিতে! এমন বাতাবরণ গায়ে কাঁটা দেয়। সন্ধ্যারতির পর আমরা লাইন দিয়ে মন্দিরের মধ্যে প্রবেশ করলাম।
কেদারনাথ মন্দিরের রহস্য | Kedarnath Darshan
কেদারনাথের উচ্চতা ১১৭০০ ফুট। আজকের এই মন্দির অষ্টম শতকে আদিগুরু শঙ্করাচার্যের তৈরী। পুরাণ মতে,পঞ্চপাণ্ডবরাই পঞ্চকেদারের প্রতিষ্ঠাতা। পঞ্চপান্ডবদের ধরা দেবেন না বলে মহাদেব পালিয়ে বেড়ান। রুদ্রপ্রয়াগের কোটেশ্বর, গুপ্তকাশীতে আত্মগোপন করে পৌঁছন কেদারনাথে। পঞ্চপাণ্ডবও পিছু ছাড়েন না। অবশেষে মহিষরূপী শিবকে জাপটে ধরেন ভীম টানাটানিতে শিবের অঙ্গচ্ছেদ হয়ে সৃষ্টি হয় পঞ্চকেদারের--- কেদারনাথে মহিষের কুঁজ, তাই কেদারনাথের বিগ্রহ কুঁজের আদলে। কল্পেশ্বরে জটা, রুদ্রনাথে মুখ, মদমহেশ্বরে নাভি আর তুঙ্গনাথে বাহু। মন্দিরটি কালো গ্রানাইট পাথরে তৈরী। নন্দী-ভৃঙ্গীও কালো মর্মর পাথরের। দরজার সামনে হাঁটু মুড়ে বসে আছে ধর্মের ষাঁড়। দ্বারে প্রহরারত গনেশ। মন্দিরের ভিতরে দ্রৌপদী কুন্তীসহ পঞ্চপাণ্ডবের মূর্তি খোদিত। আর আছে পার্বতী আর লক্ষ্মী দেবীর মূর্তি। মন্দিরের গর্ভগৃহে অবস্থান করছেন দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের অন্যতম কেদারনাথ। মাথার উপরে তার ঝুলন্ত ছাতা। দুদিন পর পূর্ণিমা , বিকেল থেকেই চাঁদ উঠেছে আকাশে। সাফাই কর্মীরা সমানে মন্দির চত্বর থেকে বরফ পরিষ্কার করে চলেছেন। রাতের আহার খিচুড়ি, পাঁপড়ভাজা আর পুরী।
ভোরবেলা কনকনে ঠান্ডা। মন্দিরের পরিবেশ স্নিগ্ধ, মায়াবী। ভিড় কম। ওম নমঃ শিবায় মন্ত্রে গমগম করছে চারদিক। ধ্যানমৌন হিমালয়। সূর্যোদয়ের অপেক্ষায়। ভোরের দর্শনে বিগ্রহকে স্পর্শও করা যায়, ফুল দিয়ে পূজো করা যায় ইচ্ছে মতো। মন্দিরের পিছনে পবিত্র ভীমশিলা যা কিনা নদীর স্রোতে ভেসে এসে রক্ষা করেছিল এই মন্দির আর বিগ্রহকে।
ভৈরব মন্দির | Bhairav Temple beside Kedarnath
কেদারনাথ মন্দিরের দক্ষিণ দিশায় এক কিমি এর একটু কম হাঁটা পথে ভৈরব মন্দির দর্শন করে আসা যায়। কালভৈরব মহাদেবের রুদ্ররূপ, যিনি ধ্বংসের দেবতা। শীতকালে কেদারনাথ মন্দির আর উপত্যকা সুরক্ষিত রাখেন তাই এনার আর এক নাম ক্ষেত্রপাল।
এবার ফেরার পালা |
অক্ষয় তৃতীয়া থেকে দীপাবলি পর্যন্ত ছয়মাস কেদারনাথ মন্দির খোলা থাকে। অর্থাৎ মোটামুটি মে মাস থেকে অক্টোবর মাস। কেদারনাথ, তুঙ্গনাথ (উচ্চতম কেদার), রুদ্রনাথ, মদমহেশ্বরের শীতকালীন আবাস উখিমঠ। একমাত্র কল্পেশ্বর মন্দিরটি অপেক্ষাকৃত নীচুতে হওয়ার জন্য সারাবছর খোলা থাকে।
এবার নীচে নামতে হবে। বার বার ফিরে ফিরে দেখি। ফিরবো বললেই ফেরা যায় না -- মনটা পড়েই থাকে। ওঠার সময় তাও মাঝে লিঞ্চলিতে থেকে এসেছিলাম কিন্তু আজ একটানা ১৬ কিমি পথই নেমে পৌঁছবো গৌরীকুণ্ডে। নামবো নামবো করেও সেই দেরী। চারপাশ বরফে মোড়া , নীল আকাশ , ঝকঝকে রোদ্দুর ! মন চায় আরো একটু দেখি , একটু বসে যাই। একটু বেলা বাড়তেই মেঘ করে আসে। নামতে নামতে আবার বৃষ্টি শুরু হয়। এপথে এমনটাই হয়। তবে ওপরে ওঠার সময় যেমন বৃষ্টি পেয়েছিলাম ততোটাও নয়। গৌরীকুণ্ডে পৌঁছনোর আগেই বৃষ্টি থেমে চাঁদ উঠে যায়।
অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্প ট্রেকিং পর্ব -১
কলকাতা থেকে হরিদ্বার হয়ে কেদারনাথ কিভাবে যাবেন | How to reach Kedarnath.
হাওড়া/দিল্লী থেকে ট্রেনে হরিদ্বার।
হরিদ্বার থেকে কেদারনাথ ।
হরিদ্বার থেকে বাসে বা ভাড়া গাড়িতে শোনপ্রয়াগ। শোনপ্রয়াগ থেকে ছোট শেয়ার গাড়িতে গৌরীকুন্ড। গৌরীকুন্ড থেকে ১৬ কিমি হাঁটাপথে কেদারনাথ। অথবা ঘোড়া, পিঠহু, ডান্ডিতে। হেলিকপ্টারে যেতে চাইলে ফাটা থেকে যেতে হবে । গুপ্তকাশী থেকে ফাটা ১৪ কিমি। নিকটতম বিমানবন্দর দেরাদুনের জলি গ্রান্ট।
কখন যাবেন | Best time to visit Kedarnath temple.
মে-জুন মাস আর পুজোর সময় ভিড় হয়। পরিস্কার আবহাওয়ার জন্য অক্টোবর খুব ভালো সময়। এছাড়া জুলাই, আগস্ট, সেপ্টেম্বর বর্ষার সময় সবুজে ঘেরা স্নিগ্ধ কেদারের রূপ দেখা যায়। তবে ধ্বসের জন্য যাতায়াতের খুব অসুবিধা হয় , রাস্তা মেরামতির কাজ লেগেই থাকে। পুজোর পর কালীপুজোর সময় মন্দির বন্ধ হওয়ার ঠিক আগে কেদারনাথ গেলে অন্যরকম অভিজ্ঞতা হবে। যদিও সেই সময় ঠান্ডার প্রকোপ বেশি থাকে।
কোথায় থাকবেন | Hotels near Kedarnath Temple.
শোনপ্রয়াগ, গৌরীকুন্ড, কেদারনাথে অনেক বেসরকারি হোটেল আছে। এছাড়া গৌরীকুণ্ডে GMVN-এর লজ আছে । কেদারনাথে আছে স্বর্গারোহিনী যা অনলাইনে বুকিং হয়। তবে স্বর্গারোহিনী থেকে মন্দির যাওয়া-আসা মিলিয়ে বেশ কিছুটা ১ কিমি মতো হাঁটতে হবে।
চলার পথে |
আমাদের সফরসূচী | Kedarnath Complete Tour Plan
- হরিদ্বার ১ রাত
- গৌরীকুন্ড ১ রাত
- লিঞ্চলি ১ রাত
- কেদারনাথ ১ রাত
- ত্রিযুগীনারায়ণ ২ রাত
- রুদ্রপ্রয়াগ ১ রাত
- হরিদ্বার ১ রাত।
প্রয়োজনীয় দূরত্ব | Distance between
- হরিদ্বার থেকে কেদারনাথ দূরত্ব :২৫২ কিমি | Haridwar to Kedarnath 252 km.
- হরিদ্বার থেকে দেরাদুন ৫২ কিমি | Haridwar to Derhadun 52 km
- হরিদ্বার থেকে রুদ্রপ্রয়াগ ১৬৩ কিমি | Haridwar to Rudraprayag 163 km.
- রুদ্রপ্রয়াগ থেকে গুপ্তকাশী ৪০ কিমি | Rudraprayag to Guptkashi 40 km.
- গুপ্তকাশী থেকে শোনপ্রয়াগ ২৮ কিমি ( গুপ্তকাশী থেকে ফাটা ১৪ কিমি, ফাটা থেকে সীতাপুর ১২ কিমি, সীতাপুর থেকে শোনপ্রয়াগ ২ কিমি )
- শোনপ্রয়াগ থেকে গৌরীকুন্ড ৫ কিমি..
- গৌরীকুন্ড থেকে কেদারনাথ ১৬ কিমি হাঁটাপথ ( গৌরীকুন্ড থেকে লিঞ্চলি ১১ কিমি, লিঞ্চলি থেকে কেদারনাথ ৫ কিমি ) | Gaurikund to Kedarnath 16 km to walk.
- গৌরীকুন্ড থেকে ত্রিযুগীনারায়ণ ১৩ কিমি | Gaurikund to Triyuginarayan 13 km.
- শোনপ্রয়াগ থেকে ত্রিযুগীনারায়ণ ৮ কিমি। Sonpryag to Triyuginarayan 8 km.