পঞ্চপ্রয়াগ ছুঁয়ে বদ্রিনাথ, বসুধারার পথে-পর্ব ১ | Badrinath Temple via Panch Prayag Pt 1

kartik swami temple
কার্ত্তিকস্বামী মন্দির

 রুদ্রপ্রয়াগ-কোটেশ্বর-কার্ত্তিকস্বামী মন্দির | Rudraprayag - Koteshwar Cave - Kartik Swami Temple.

গঙ্গাই হরিদ্বারের মূল আকর্ষণ। তাই হরিদ্বারে থাকলে অবশ্যই থাকা উচিত গঙ্গার ধারে। হিমালয়ের মধ্যে দিয়ে অনেক পথ অতিক্রম করে সমতলে প্রবেশ করেছে গঙ্গা নদী। তবে, এই স্রোত গঙ্গার নিজস্ব নয়। শহরের উত্তরে ভীমগোদায় বাঁধ দিয়ে কৃত্রিম স্রোত তৈরি করা হয়েছে হর-কি-পৌরি বরাবর।এখান থেকে বিষ্ণুঘাট পর্যন্ত টানা নদীর ধার ধরে হোটেল-ধর্মশালা-বাজার-দোকান-মন্দির। গরম বাসমতী চালের ভাতে ঘি, ডাল, ভাজা, তরকারি, চাটনি----যেন অমৃত! হরিদ্বারে আমিষ খাবার নিষিদ্ধ। হরিদ্বারের অন্যতম দ্রষ্টব্য মনসা পাহাড় , চন্ডী পাহাড় তো আছেই--রোপওয়ে যায়। শহর থেকে ৫ কিমি দূরে কনখল--দক্ষ প্রজাপতির মন্দির। আনন্দময়ী মায়ের আশ্রম ও ভারতমাতা মন্দির থেকেও ঘুরে আসা যায়। শহর থেকে ২৪ কিমি দূরে হৃষিকেশ। হরিদ্বারের তুলনায় অনেক শান্ত ও নির্জন। সন্ধ্যারতির সময় ফিরে আসি হর-কি-পৌরি ঘাটে। গঙ্গামাতার উদ্দেশ্যে বহু মানুষের ভাসানো ফুলের ডালাসহ প্রদীপ স্রোতের দোলায় ভেসে যেতে থাকে। শুরু হয় সব মন্দির থেকে স্তোত্রপাঠ, শাঁখ, কাঁসর, ঘন্টাধবনি। প্রদীপ ও মশালের আলোয় যেন গঙ্গার বুকে নতুন সূর্য জেগে ওঠে। এইভাবেই বেশ কিছুক্ষণ ধরে চলে গঙ্গারতি ও দেবীবন্দনা।

আরও পড়ুনঃ নতুন পথে কেদারনাথ

হরিদ্বার থেকে রুদ্রপ্রয়াগ | Haridwar to Rudraprayag 

এবার হরিদ্বার থেকেই আমরা আগামী সফরের জন্য গাড়ি বুক করে নিয়েছি। হরিদ্বার থেকে হৃষিকেশ , লছমনঝুলা হয়ে দেবপ্রয়াগ পৌঁছে গেলাম। গঙ্গানদীর গঙ্গা নামের উৎপত্তি এই দেবপ্রয়াগ থেকেই। এখান থেকে অলকানন্দা ও ভাগীরথীর মিলিত প্রবাহ মর্ত্যে অবতরণ করে গঙ্গা নামে। এখান থেকে গঙ্গার সঙ্গ ছেড়ে অলকানন্দার সঙ্গলাভ। পঞ্চপ্রয়াগের সবকটি সংগমের সঙ্গে অলকানন্দা জড়িত। দেবপ্রয়াগের নৈসর্গিক শোভা মনোহর। দেবপ্রয়াগ থেকে প্রায় ৩৭ কিমি দূরে শ্রীনগর জেলা সদর শহর। এখান থেকে অন্য পথে ৩০ কিমি দূরে এক সুন্দর শৈলশহর পউরি, সেখান থেকে খিরসু। আগে দু-বার গিয়েছিলাম ওই পথে। শ্রীনগরের মতো এত প্রশস্ত উপত্যকা অলকানন্দার অন্য কোথাও নেই। পঞ্চপ্রয়াগের মধ্যে রুদ্রপ্রয়াগের নদী সঙ্গম বোধহয় সবচাইতে বেশি অশান্ত। এখানে অলকানন্দা আর মন্দাকিনী দুই স্বর্গকন্যার মিলন হয়েছে। হরি-হরের আশীর্বাদধন্যা দুই কন্যা। দুটো নদীই পাথরের বোল্ডারে বাধা পেয়ে প্রচন্ড গতিতে পরস্পরের উপর আছড়ে পড়ছে। দুই নদীর জলের রঙের পার্থক্যের জন্য সংগমস্থলটা স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান। জলের রঙের এই পার্থক্য দেবপ্রয়াগেও খুব পরিস্কার বোঝা যায়। 

রুদ্রপ্রয়াগের সংগমঘাটটির নাম সূর্যপ্রয়াগ। সংগমের সর্বোচ্চ স্থানে রয়েছেন অধিষ্ঠাতা রুদ্রনাথ শিব। পৌরাণিক উপাখ্যান অনুসারে, দেবর্ষি নারদ এই সংগমে বসেই শিবের তপস্যা করেছিলেন। শিব তুষ্ট হয়ে নাদ-চর্চা করেছিলেন যার ফলে ছয় রাগ ও রাগিণী উপস্থিত হয়েছিলেন। শিব এখানেই নারদকে তাঁর বীণাটি দান করেছিলেন। অন্য একটি কারণেও রুদ্রপ্রয়াগ বিখ্যাত। বহু বছর আগে গভীর অরণ্য ছিল এসব বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে। শিকারি জিম করবেট এই রুদ্রপ্রয়াগেই মানুষখেকো চিতা ও বহু বাঘ মেরে অসংখ্য মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন। রুদ্রপ্রয়াগের সৌন্দর্য্য ও মাহাত্ম্য দেখতে এবং বুঝতে হলে সংগমের একেবারে কাছে কালিকম্বলির ধর্মশালায় থাকতে হবে। বিশাল বিশাল ঘর । তবে রক্ষণাবেক্ষণের বেশ অভাব। নীচে অলকানন্দা, অদূরে সংগম, ঘর থেকেই দেখা যায়। আগেও একবার এখানে থেকেছিলাম। 

Koteswar Temple
কোটেশ্বর, রুদ্রপ্রয়াগ

শৈবতীর্থ কোটেশ্বর গুহা-মন্দির | Koteshwar Shiva Cave

অলকানন্দার পশ্চিম তীর ধরে শহর থেকে মাত্র ৩ কিমি দূরে এক প্রসিদ্ধ শৈবতীর্থ কোটেশ্বর। এপথে জিপ চলাচল করে । নদীর ধারে পাহাড়ের গায়ে গুহামন্দির। অন্দরে অজস্র শিবলিঙ্গ। বিশ্বাসীরা বলেন, অলকানন্দার তপস্যাতে কোটি শিব প্রকট হয়েছেন। নাম তাই কোটেশ্বর। পুরাণ মতে, পঞ্চপাণ্ডবের পাপের ভাগ নেবেন না বলে মহাদেব যখন পালিয়ে বেড়ান তখন এই গুহায় এসে লুকিয়ে ছিলেন, তারপর গুপ্তকাশী হয়ে কেদারনাথ পৌঁছন। ভূ-বিজ্ঞানীরা বলেন, বর্ষায় অলকানন্দা গুহার মধ্যে ঢুকে ভয়ানক আবর্তের সৃষ্টি করে। বহুকাল ঘূর্ণনের ফলে পাথর ক্ষয়ে বিভিন্ন আকারের ও রঙের এমন সব শিবলিঙ্গের রূপ নিয়েছে। ক্রমাগত সৃষ্ট হয়ে চলেছে প্রাকৃতিক শিবলিঙ্গ। গুহা মন্দিরে অবিরত তিরতির করে ঝরে পড়ছে ঝর্ণার জল। শান্ত আর নিরিবিলি পরিবেশে পাহাড় আর নদীর মেলবন্ধনে অপূর্ব প্রাকৃতিক শোভা। ভেসে আসছে পাখির ডাক। মন আপনা থেকেই তন্ময় হয়ে আসে।

কনকচৌরি ও কার্ত্তিকস্বামী মন্দির | Kanakchauri & Kartik Swami Temple.

রুদ্রপ্রয়াগ থেকে প্রায় ৪০ কিমি দূরে এক শান্ত নির্জন গ্রাম কনকচৌরি। হাতে গোনা কয়েকঘর লোকজন নিয়ে একটি ছোট্ট গ্রাম। তাই থাকার জায়গা বেশি নেই। এখানে আসার কারণ কার্ত্তিকস্বামী মন্দির। নীচ থেকেই দেখা যাচ্ছে পাহাড়চূড়োয় ঠিক কোথায় পৌঁছতে হবে। ৩ কিমি হাঁটাপথ কিন্তু পুরোটাই চড়াই। জঙ্গল আর পাথুরে রাস্তা। কনকচৌরিতে মায়াদীপ হলিডে হোমে থাকার জায়গা পেয়ে গেলাম সহজেই। পরিবেশের সঙ্গে বেশ মানানসই করে তৈরি। দেখেই পছন্দ হয়ে যাওয়ার মতো।

অন্ধকার থাকতে ঘুম থেকে উঠে প্রস্তুত হয়ে নিই। যাতে সূর্যোদয়ের আগে পৌঁছতে পারি পাহাড়ের মাথায়। টর্চ হাতে বেরিয়ে পড়ি। প্রথমে হাঁটতে একটু অসুবিধা হলেও ধীরে ধীরে ধাতস্ত হয়ে যাই। অন্ধকারে দেখার কিছুই নেই, শুধু সাবধানে এগিয়ে চলা। খুব অল্প আলোয় বাঁ-দিকের উন্মুক্ত উপত্যকায় ঢেউ খেলানো পাহাড়ের স্তর দেখা যাচ্ছে। অন্ধকার একটু ফিকে হতে দূর আকাশে লালচে আভা। অন্ধকারে পথ হারিয়ে সামনে ভুল পথে এগিয়ে যাই, আবার ফিরে এসে ঠিক পথ ধরি। সারা রাস্তায় ঘর-বাড়ি কিছুই নেই। শুধু মন্দিরের কিছুটা নীচে পুরোহিত মহাশয়ের ছোট্ট আস্তানা। মন্দিরে পৌঁছনোর শেষ রাস্তাটুকু একেবারে পাহাড়ের গা বেয়ে। খুব সাধারণ মন্দির, অনেকটা খোলা চত্বর রেলিং দিয়ে ঘেরা। এখানে দাঁড়িয়ে মনে হয় পৃথিবীর ঝুল-বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি, এই বুঝি পৃথিবীর শেষ প্রান্ত মাঝখানে অপার শূন্যতা পেরিয়ে গা-ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে আছে বন্দরপুঁছ, কেদারনাথ, কেদারডোম, চৌখাম্বা, কামেট, নীলকণ্ঠ, দ্রোণাগিরি, নন্দাঘুন্টি, ত্রিশূল, নন্দাদেবীর মতো বিখ্যাত সব তুষারশৃঙ্গের সারি। সূর্যোদয়ের সাথে সাথে এক স্বর্গীয় দৃশ্যের সাক্ষী থাকি। নরম রোদ্দুর খেলে যায় উপত্যকা জুড়ে। ধীরে ধীরে নীচে নামতে থাকি। মাঝে পুরোহিত মহাশয়ের আস্তানায় কিছুক্ষণের চা পানের বিরতি। রাতের অন্ধকারে পথের কিছুই বোঝা যাচ্ছিল না। দিনের আলোয় দেখি সারা রাস্তাতেই ঘন রডোডেনড্রনের জঙ্গল। মার্চ-এপ্রিলে ফুলের বন্যায় ভেসে যায় এই পথ! উঁচু গাছেদের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে চৌখাম্বাসহ অন্যান্য গিরিশিখর।

Bishnu prayag
বিষ্ণুপ্রয়াগ

কর্ণপ্রয়াগ, নন্দাপ্রয়াগ, বিষ্ণুপ্রয়াগ | Karnaprayag , Nandaprayag , Vishnuprayag

নীচে নেমে জলখাবার সেরে বেরিয়ে পড়ি বদ্রিনাথের উদ্দেশ্যে । আবার একই পথে রুদ্রপ্রয়াগ ফেরার দরকার নেই। এখান থেকেই সামনের পথ চলে গেছে পোখরি হয়ে কর্ণপ্রয়াগের দিকে, সেই পথ ধরে এগিয়ে চলি।

কুমায়ুনের পিণ্ডারি হিমবাহ থেকে নেমে এসেছে পিণ্ডারগঙ্গা। গাড়োয়ালে তার নতুন নাম কর্ণগঙ্গা। এখানে কর্ণগঙ্গা আর অলকানন্দার সংগম। এই কর্ণপ্রয়াগেই মহাবীর কর্ণ সুদীর্ঘ তপস্যা করেছিলেন সূর্যদেবের। তুষ্ট হয়ে সূর্যদেব কর্ণকে কবচ-কুণ্ডল দান করেছিলেন। দুটো কুন্ড সংগমঘাটে---- কর্ণকুন্ড ও সূর্যকুন্ড। কর্ণের মন্দিরে কর্ণ ও তাঁর স্ত্রী পদ্মাবতীর মূর্তি রয়েছে। আর আছে সূর্য মন্দির।

কর্ণপ্রয়াগ থেকে নন্দপ্রয়াগ ২০ কিমি। এখানে রয়েছে নন্দাকিনী নদী এবং অলকানন্দার রমনীয় সংগম। বিস্তীর্ণ দীর্ঘ উপত্যকা , আসল নাম নন্দাপ্রয়াগ। মুখে মুখে নন্দা হয়ে গেছে নন্দ। এরপর চামোলি। অলকানন্দার এপারে চামোলি ওপারে গোপেশ্বর। গোপেশ্বরকে পাশ কাটিয়ে পিপুলকুঠি, গরুড়গঙ্গা হয়ে পৌঁছে যাই জোশিমঠ। জোশিমঠে ফেরার সময় থাকবো, যাবো আউলি আর পঞ্চম কেদার কল্পেশ্বর। 

এখন এগিয়ে যাই বদ্রিনাথের দিকে। জোশিমঠ থেকে বদ্রিনাথের দূরত্ব ৪২ কিমি। জোশিমঠের অদূরেই বিষ্ণুপ্রয়াগ। উদ্দামগতিতে প্রবাহিত ধৌলিগঙ্গা বা বিষ্ণুগঙ্গা মিলিত হয়েছে অলকানন্দার সঙ্গে। খাঁড়া পাহাড়ের দেওয়াল, সবুজে ছাওয়া বনভূমি, শান্ত, নির্জন বিষ্ণুপ্রয়াগে পর্যটকের ভিড় নেই বললেই চলে।

চলবে....(to be continued)

পঞ্চপ্রয়াগ ছুঁয়ে বদ্রিনাথ, বসুধারার পথে- পর্ব ২
পঞ্চপ্রয়াগ ছুঁয়ে বদ্রিনাথ, বসুধারার পথে- পর্ব ৩

 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন