মায়াময় মিয়ার উপত্যকা লাহুল |
মায়াময় মিয়ার উপত্যকা লাহুল ভ্রমণ গাইড |
হিমাচলপ্রদেশের লাহুল উপত্যকা (Lahul ) যেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের লীলাভভূমি। বরফে ঢাকা পাহাড় যেমন আছে তেমন বরফহীন শুষ্ক, রুক্ষ কঠিন পাথরের পাহাড়ও রয়েছে এই মিয়ার উপত্যকা (Miyar Valley ) ঘিরে। পাইন, ওক, ফার, দেওদার, পপলার, বার্চ গাছের গহন বনভূমি আছে; আবার সবুজের চিহ্নহীন অনুর্বর প্রান্তরও দৃশ্যমান। তবে লাহুল উপত্যকা স্পিতি মত অতটা রুক্ষ বা কর্কশ নয়। মাঝে মধ্যেই নয়ন জুড়ানো শ্যামলিমা। স্পিতিতে ধূমল মাডি পাহাড়ের যেমন আধিক্য , এদিকটা তুলনায় পাথুরে।
মানালি থেকে রোটাং পাস পেরিয়ে কোকসার, গ্রামফু, তান্ডি, ত্রিলোকনাথ, উদয়পুর ছাড়িয়ে পথ চলে গেছে হিমালয়ের অন্দরমহলে। তারপর গাড়িপথ শেষ হয়ে শুরু হয়েছে হাঁটাপথ। আমাদের এবারের গন্তব্য শেষ গাড়িপথটুকু পর্যন্ত। শুরু থেকে পুরো যাত্রাপথটাই নদীর তীর ধরে। কখনো বিপাসা, কখনো চন্দ্রা, কখনো বা চন্দ্রভাগা, তো কখনো মিয়ার নালা।
আরও পড়ুনঃ
সিসু, লাহুল উপত্যকা হিমাচলপ্রদেশ
মানালি থেকে রোটাং-পাসের পথে | Manali to Rohtang Pass , Himachal Pradesh
চির-পাইনের সারি, আপেল, ন্যাসপাতি বাগান আর বিপাসা নদীর হাত ধরে নেহরু কুন্ড, কোঠি, রহলা, মাড়ি পেরিয়ে ক্রমশঃ চড়াই আর হেয়ার-পিন বাঁক অতিক্রম করে মানালি থেকে ৫১ কিমি দূরে রোটাং পাস শীর্ষ (৩৯৭৮ মিটার)। মাঝে মাড়িতে চা-ম্যাগি বিরতি। ঝলমলে রোদ্দুর, খটখটে শুকনো রোটাং পাস! বরফের লেশমাত্র নেই, অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহ চলছে। তবে চারপাশে তুষারশৃঙ্গ ঝকঝক করছে। এ যাত্রায় মনে মনে এমনটাই চেয়েছিলাম। একটু নীচে একজায়গায় দেখলাম ব্যাস ঋষি মন্দির---- ভেতরে জলের ধারা। কথিত আছে, বেদব্যাস ১২ বছর এখানে তপস্যা করে এই জলধারা সৃষ্টি করেন। এই জলে নাকি রোগ-ব্যাধি দূর হয়। আগেও রোটাং পাস এসেছিলাম, এত বরফ ছিল যে এই জায়গাটা চোখে পড়েনি। এটি বিয়াস নদীর অন্যতম উৎস বলে মনে করা হয়। আর একটি বিয়াসকুন্ড যা ট্রেক করে যেতে হয় মানালি থেকে ধুন্দি হয়ে।
তান্ডি হয়ে কেলং-এ রাতের বিশ্রাম | Keylong via Tandi , Lahul
এবার ১১ কিমি উৎরাই পথে গ্রামফু পেরিয়ে চন্দ্রা নদীকে সঙ্গী করে এগিয়ে চলা। গ্রামফু থেকে রাস্তা চলে গেছে স্পিতি উপত্যকার দিকে। সে পথ গেছে কাজা হয়ে কিন্নর জেলায়। চন্দ্রতাল হিমবাহ থেকে যেমন নেমে এসেছে চন্দ্রানদী তেমনি অন্যদিকে বরালাচা-পাসের ঠিক নীচে সূরযতাল হিমবাহ থেকে নেমে এসেছে ভাগা নদী। তান্ডি জনপদে এসে চন্দ্রা মিলিত হয়েছে ভাগার সঙ্গে। ওই মিলিত ধারার নামই চন্দ্রভাগা। দক্ষিণ-পশ্চিম বাহিনী হয়ে চন্দ্রভাগা কাশ্মীর উপত্যকায় প্রবেশ করেছে চেনাব নাম নিয়ে। তান্ডি থেকে পথ ভাগ হয়ে একটা চলে গেছে চন্দ্রভাগা নদীর তীর ধরে ত্রিলোকনাথ-উদয়পুরের দিকে। আর ভাগা নদীর অববাহিকা ধরে একটা রাস্তা চলে গেছে ৮ কিমি দূরে কেলং শহরের দিকে।
ত্রিলোকনাথের পথে | Triloknah Temple
হিমাচলপ্রদেশের শ্রেষ্ঠতম ও পবিত্রতম তীর্থ ত্রিলোকনাথ (২৭৬০ মিটার)। হিন্দু-বৌদ্ধ উভয় সম্প্রদায়ের কাছেই এ এক মহাতীর্থ। যে বিগ্রহ হিন্দুরা পুজো করেন ত্রিলোকেশ্বর শিব জ্ঞানে, ওই একই বিগ্রহ লামাদের চোখে অবলোকিতেশ্বর। মন্দিরের একদিকে চন্দ্রভাগার গভীর খাদ, দূরে লাহুল উপত্যকা এবং অন্যদিকে চাম্বার গিরিশ্রেণীর তুষারধবল শোভা। জাসকার পর্বতমালার অনেকটাই এখান থেকে দেখা যায়। ত্রিলোকনাথে ধর্মীয়, সামাজিক ও পারিবারিক জীবন যাপনে তিব্বতীয় ঘরাণার প্রভাব দেখা যায়।
উদয়পুর/উদেপুর |Udaipur in Lahur
প্রায় ১৬ কিমি সড়কপথ গেছে ত্রিলোকনাথ থেকে উদয়পুরে (২৬৫০ মিটার)। এ যাত্রাপথও বড়ো মনোরম। উদয়পুরে ঢোকার মুখে মিয়ার নালা পড়েছে চন্দ্রভাগার বুকে। আগামীকাল যাবো সেই স্বপ্নমাখা, মায়াময় মিয়ার উপত্যকা! শান্ত, ছড়ানো ছেটানো জনপদ উদয়পুর। বাসস্ট্যান্ডের কাছেই বিখ্যাত মৃকুলাদেবীর মন্দির, রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নিয়েছে পুরাতত্ত্ব বিভাগ। মন্দিরের সূক্ষ্ম কারুকার্য অনেক জায়গায় নষ্ট হয়ে গেছে। গর্ভগৃহে অষ্টধাতুর তৈরি অষ্টভুজা মহিষাসুরমর্দিনী এখানে দেবী কালী রূপে আরাধ্যা। হিন্দু এবং বৌদ্ধ উভয় ধর্মাবলম্বী মানুষদের কাছেই এই দেবীপ্রতিমা শ্রদ্ধার সঙ্গে পূজিতা।
মিয়ার উপত্যকার অন্দরে | Miyar Valley sightseeing
উদয়পুর থেকে মিয়ার নদীর তীর ধরে পথ চলে গেছে উপত্যকার গহন গভীরে। দুর্বার গতিতে , কাকচক্ষু স্বচ্ছ, হিমশীতল জলধারা নিয়ে ধাবমান মিয়ার নদী গভীর গিরিখাতের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছে। মিয়ার উপত্যকার দৈর্ঘ্য প্রায় ৭৫ কিমি এবং উচ্চতা ১০,০০০ ফুট থেকে ১৭,৫০০ ফুটের মধ্যে। আমরা যাচ্ছি মিয়ার ভ্যালির মধ্যভাগে, যতটা গাড়ি পথে যাওয়া সম্ভব। কেলং থেকে একটি এবং উদয়পুর থেকে দুটি বাস আসছে এই পথে, সুক্তো গ্রাম পর্যন্ত। একে একে পেরিয়ে যাচ্ছি ছোট ছোট গ্রাম-- শাকোলি, চামরাট, কারপাট, গোমপা, তিংরিত। তিংরিতে পুলিশ চেকপোস্টের সামনে সাময়িক বিরতি। পরিচয়পত্র দেখিয়ে আবার এগিয়ে চলা। খুবই ছোটো ছোটো গ্রাম, লোকবসতি খুবই কম। নানান বৈচিত্র্যেভরা এ পথ। এমনই মনোমুগ্ধকর শোভা যে বার বার দাঁড়িয়ে পড়তে হয়। অপরূপা ঊরগোস এখানকার সবথেকে বড় গ্রাম। হসপিটাল, মনাস্ট্রি, হেলিপ্যাড, সবুজ চাষের জমি আর দূরে তুষারাবৃত পর্বতশ্রেণী নিয়ে আমাদের চেনা পৃথিবীর বাইরে এক আশ্চর্য্য অপার্থিব জগৎ। এরপর চিলিং পেরিয়ে সুক্তো গ্রাম (৩৪৫০ মিটার), উদয়পুর থেকে দূরত্ব মাত্র ২৯ কিমি। এত ভেতরদিকে হলেও রাস্তা বেশ ভালো বলেই মনে হল। এরপর শুরু হচ্ছে দীর্ঘ হাঁটাপথ। মিয়ার গ্লেসিয়ারের উপর দিয়ে প্রায় ৩০ কিমি চলার পর কাংলা পেরিয়ে জাসকার-এর পাদুম চলে যাওয়া যায়। আরো যেতে চাইলে সিঙ্গলা পেরিয়ে সুমদো, দারচা হয়ে মানালি।
মিয়ার নদীর একদিকে সুক্তো, অপরদিকে খনজর | Shukto , Khanjar village
সুক্তোতে একটিইমাত্র খুব সাধারণমানের থাকার জায়গা আছে। সুক্তোর হোমস্টে থেকে আরো কিছুটা এগিয়ে, মিয়ার নদীর ওপর ঝুলন্ত কাঠের ব্রীজ পেরিয়ে চলে যাওয়া যায় খনজর গ্রাম পর্যন্ত। মিয়ার নদীর এক পাড়ে সুক্তো, অপর পাড়ে খনজর। ১,২০০ ফুট উচ্চতা পর্যন্ত এখানে রডোডেনড্রন, ফার, বার্চ গাছের দেখা মেলে। আরো ওপরের দিকে সবুজের চিহ্ন দুর্লভ। যদিও এখন রডোডেনড্রনের সময় নয় তাও হেমন্তের পরশ পেয়ে গাছের পাতাগুলি এমন হলুদ, কমলা, গোলাপী, লাল আভা বিচ্ছুরণ করছে তার সৌন্দর্য্য ভাষায় প্রকাশ করার নয়। কোথাও ভাষা হারিয়ে যায়, বাকরুদ্ধ হয়ে যায়, আর কোনো বিশেষণই মনে আসে না---- মিয়ার এমনই এক অনুভূতি।
এই উপত্যকায় বৃষ্টিপাত অল্পই, বছরে মাত্র দুই-তিন ইঞ্চি। অনুর্বর জমি ও কম বৃষ্টিপাতের ফলে এদিকে চাষবাস কমই হয় এবং শিক্ষার প্রসারও খুব কম। এই সময় এদিকে সর্বত্র আলু মূলোর চাষ চোখে পড়ার মতো। শীতকালে গোটা উপত্যকা বরফে ঢেকে যায়।
হোম-স্টের সামনে থেকে রাস্তা নেমে গেছে নদীর চড়ে। ওপরে নীল আকাশ, নীচে সাদা প্রস্তরময় পথ, উদ্দাম গতিতে সফেন হিমশীতল জলধারা নিয়ে প্রবাহিত নদী। দুপুরের খাওয়া সেরে নেমে এলাম নদীর চড়ে। সারাটা দুপুর কেটে গেল চড়ে ঘুরে বেড়িয়ে আর পাথর কুড়িয়ে। রোদ্দুর নরম হতে শুরু হল ঠান্ডা হাওয়ার দাপট। ফিরে চলি আস্তানায়।
যতই ঠান্ডা হাওয়া চলুক, পাহাড়ে সন্ধ্যা না নামলে ঘরে যেতে মন চায় না। আনমনে দাঁড়িয়ে আছি হোম-স্টের উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে। সামনে ধূ ধূ ধূসর উপত্যকা। হঠাৎই এক অকল্পনীয় বাতাবরণ সৃষ্টি হয়! সূর্যের পড়ন্ত আলোয় ন্যাড়া পাহাড়গুলি সোনালী বর্ণ ধারণ করে, আর তার ওপর অন্য পাহাড়ের ঢেউ খেলানো ছায়ার স্তর পড়তে থাকে এক এক করে। সূর্যোদয়-সূর্যাস্তে তুষারশৃঙ্গে রঙের খেলা অনেক দেখেছি। কিন্তু ন্যাড়া পাহাড়ের এমন রূপ জীবনে এই প্রথম দেখলাম! সত্যিই তো! আমরা এখন মরু-পর্বতের রাজ্যে! ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নামে উপত্যকার বুকে। উপত্যকা ঘুমিয়ে পড়ে, জেগে ওঠে নক্ষত্রলোক। কেটে যায় এক আদিম রাত্রি। এবার একই পথ ধরে মানালি ফিরে চলা। মাঝে সিসুতে একদিনের বিশ্রাম।
কিভাবে যাবেন | How to visit Miyar Valley , Lahul , Himachal Pradesh
হাওড়া থেকে ট্রেনে কালকা বা চন্ডীগড় হয়ে বাস/গাড়িতে মানালি। অথবা দিল্লী থেকে ডিলাক্স বাস/গাড়িতে মানালি। মানালি থেকে গাড়ি ভাড়া করে ঘোরাই সুবিধাজনক। বাসেও ঘোরা যায়, সেক্ষেত্রে হাতে সময় বেশি নিয়ে বেরোতে হবে।
কোথায় থাকবেন | Hotel , Home Stay in Miyar Valley
কেলং-এ হোটেল সুমরিলা গেস্ট হাউস (Ph no:- 09418430479 or
09418660998), ওল্ড বাসস্ট্যান্ড।
এছাড়া স্নো-ল্যান্ড, সরকারী লজ চন্দ্রভাগা।
উদেপুরে তিন-চারটি সাধারণমানের থাকার জায়গা আছে। প্রকাশ ধাবা/গেস্ট হাউস, মৃকুলাঞ্চলধাবা/গেস্ট হাউস (089880-13905 / 094590-13910)
মিয়ার ভ্যালির সুক্তো গ্রামে একটাই সাধারণমানের থাকার জায়গা আছে।
তাসি হোমস্টে (09459904065 / 09459988998)। এখানে একটাই কমন টয়লেট।
সিসুতে পাম ধারা (09418118873 /
09459915888)
এছাড়াও আরো কিছু ভালো হোটেল আছে।
কখন যাবেন | Best time to visit Miyar Valley , Lahul , Himachal Pradesh
লাহুল উপত্যকার রাস্তা খোলা থাকে মে মাসের শেষভাগ থেকে অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত। তাই এই স্থান ভ্রমণের এটাই মরসুম।
কিছু প্রয়োজনীয় দূরত্ব | Distance between
- চন্ডীগড় থেকে মানালি ৩১০ কিমি। Chandigarh to Manali 310 k.m.
- মানালি থেকে রোটাং পাস হয়ে কেলং প্রায় ১১৫ কিমি |Manali to Kelong via RohtangPass 115 km
- মানালি থেকে অটল টানেল হয়ে কেলং প্রায় ৭০ কিমি | Manali to kelong via Atal Tunnel 70 km
- তান্ডি থেকে ত্রিলোকনাথ হয়ে উদয়পুর প্রায় ৪৫ কিমি। Tandi to Udaipur via Triloknath 45 km
- উদয়পুর থেকে সুক্তো ২৯ কিমি। Udaipur to Shukto ,Lahul district 29 km
- সুক্তো থেকে সিসু প্রায় ১১৫ কিমি। Shukto to Sissu village Lahul 115 km.
- সিসু থেকে রোটাং পাস হয়ে মানালি প্রায় ৮৫ কিমি। Manali Himachl to Sissu via Rohtang Pass
- (সিসু থেকে অটল টানেল হয়ে মানালি প্রায় ৪০ কিমি)। Manali Himachl to Sissu via Atal Tunnel
অপূর্ব ছবিসহ বর্ণনা। শুভেচ্ছা রইলো মৌসুমী।
উত্তরমুছুন