অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্প ট্রেকিং, নেপাল-পর্ব ১ | Annapurna Base Camp Trek, Nepal Part I

এক স্বপ্নের ট্রেক পথে |ট্রেকরুট অন্নপূর্ণা-বেস-ক্যাম্প

এক স্বপ্নের ট্রেক পথে |ট্রেকরুট অন্নপূর্ণা-বেস-ক্যাম্প (ABC ) সার্কিট ট্রেক 

নেপাল ! ঘরের পাশেই এমন বিদেশ যেখানে যাওয়ার জন্য পাসপোর্ট বা ভিসার প্রয়োজন নেই। শুধু ভোটার্স আইডেন্টিটি কার্ড হলেই চলবে।

উত্তুঙ্গ পর্বতশ্রেণী, নদী, হ্রদ, জঙ্গল, মন্দির, মনাস্ট্রি, প্রাচীন প্রাসাদ আর তার পাশাপাশি চোখধাঁধানো মার্কেট, রেস্টুরেন্ট, ক্যাসিনো, বিদেশি গাড়ি কি নেই ! কিন্তু এইসব কিছু ছাড়িয়ে নির্ভেজাল প্রকৃতির সান্নিধ্য উপভোগ করতে চাইলে নেপালের ট্রেক রুটগুলিরও তুলনা মেলা ভার।

প্রায় চারবছর ধরে দেখতে থাকা একটা স্বপ্ন সত্যি হওয়ার পথে, আমরা নেপালের পথে ----  গন্তব্য নেপালের অন্যতম জনপ্রিয় ট্রেকরুট অন্নপূর্ণা-বেস-ক্যাম্প ট্রেক। 

আরও পড়ুনঃ পঞ্চচুল্লি বেস-ক্যাম্প ডারমা উপত্যকা

রক্সৌল-বীরগঞ্জ | Raxaul to Birgunj , Nepal border

২০২২ সালের ২ রা নভেম্বর হাওড়া- রক্সৌল মিথিলা এক্সপ্রেসে ( ১৩০২১) চেপেছি। দুপুর ৩-৪৫ এ ট্রেনটি হাওড়া স্টেশন থেকে ছেড়ে ৩ রা নভেম্বর ঠিক সকাল ৮-৩০ টায় রক্সৌল পৌঁছে গেছি, নির্ধারিত সময়ের আধঘন্টা আগেই। স্টেশন থেকে বেরিয়েই বাইরে টোটো, টাঙ্গা। ট্রেন যেদিকে নামায় ওদিক দিয়ে বা-ঁদিকে এগিয়ে এসে বাইরে বেরোলে সুবিধা। ডানদিকে মেইন গেটের দিক দিয়ে গেলে সময় নষ্ট হয়। আমরা একটা টাঙ্গায় বর্ডার এলাকা পেরিয়ে  বীরগঞ্জে পৃথ্বী বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছই। ভাড়া ২৫০ টাকা। রক্সৌল থেকে ৩ কিমি দূরে নেপালের সীমান্ত শহর বীরগঞ্জ। এখান থেকে বাসে টানা পোখরা।

বীরগঞ্জের পৃথ্বী-বাস-চৌক

এখানে কিছু কথা বলে রাখি। টাঙ্গায় চেকিং কম করে টোটোর তুলনায়। তবে টাঙ্গায় সময় বেশি লাগে।  বীরগঞ্জ থেকেই কিছু ভারতীয় টাকা নেপালী টাকায় বদলে নিলে ভালো হয় কারণ ট্রেকরুটে ভারতীয় টাকা চলে না। ১০০ টাকা চললেও সব জায়গায় নিতে চায় না। পোখরার হোটেল থেকেও কিছু টাকা বদলে নেওয়া যায়। পোখরায় সবই চলে। রক্সৌল থেকে বীরগঞ্জ আসার পথে টাঙ্গাওয়ালা দুবার মাঝপথে নামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল, সেখান থেকেও নাকি বাস-ট্যাক্সি পাওয়া যায়, কিন্তু আমরা নামিনি। সোজা বীরগঞ্জের পৃথ্বী বাস চৌক -এ নামাই ভালো। রক্সৌল থেকে বীরগঞ্জের পৃথ্বী বাস চৌক -এর দূরত্ব ৬ কিমি।

কাউন্টার থেকে টিকিট কেটে বাসে উঠে বসি।ভাড়া জনপ্রতি ৮৭০ নেপালী টাকা। আমরা এখন নেপালে তাই এখান থেকে সবকিছু নেপালী টাকার হিসাবেই চলবে। যদিও ভারতীয় টাকা সর্বত্র চলে, ট্রেকরুট ছাড়া। তবে খুচরো কেনাকাটা করলে বারবার ওই হিসাব করা মুশকিল তাই কিছু নেপালী টাকা সবসময় সঙ্গে থাকলে ভালো। নেপালী  ১৬০ টাকা মানে ভারতীয় ১০০ টাকা---- এইরকম হিসাব। নেপালে কোনো জিনিসের দাম যদি ৭০০ টাকা হয় তাহলে ভারতীয় টাকায় তার দাম হবে ৭০০ × ০.৬২৫ টাকা। ভারতীয় সময়ের থেকে নেপালী সময় ১৫ মিনিট এগিয়ে। নেপালী সিম না নিলেও wifi নিয়ে ক-দিন ভালোই কাজ চলে যায়।

পোখরার পথে | Way to Pokhara , Nepal

বাস ছেড়ে দিল ১০-৪০ নাগাদ। বাসে বেশ ভিড় হয় তাই ট্রেন থেকে নেমে সময় নষ্ট না করে তাড়াতাড়ি বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে টিকিট কেটে নেওয়া উচিত। প্রায় ৯/১০ ঘন্টার পথ। দূরত্ব ২৬০ কিমি। অনেকটা পথ চিতওয়ান জঙ্গলের ওপর দিয়ে ---- নারায়ণগড়, ভরতপুর হয়ে । এদিকে রাস্তা ভালোই। দুমড়ের পর রাস্তার অবস্থা বেশ খারাপ। কোথাও কোথাও রাস্তার কাজ চলছে। আমাদের পোখরা পৌঁছতে রাত ৮ টা বাজলো। পোখরা বাসস্ট্যান্ড থেকে লেক-সাইড যাওয়ার জন্য ট্যাক্সি ভাড়া ৪০০ টাকা (ভারতীয় ২৫০ টাকা)।  লেকসাইডে অনেক হোটেল আছে। সুন্দর সাজানো-গোছানো এদিকটা। আমরা লেক-স্যাডো তে ঘর নিলাম। ঘর ভাড়া ১২০০-১৫০০ নেপালী টাকা। ডাল-ভাত খালি ৩২৫ টাকায় খেয়ে শুয়ে পড়লাম। সকালে অনেক কাজ। 

বহুবছর আগে একবার নেপাল এসেছিলাম। তখন পোখরা, মনোকামনা, কাঠমান্ডু ঘুরেছিলাম। সেই সময় পোখরাকে স্বপ্নের শহর মনে হয়েছিল। এখনো ভালো লাগছে। পোখরার প্রাণকেন্দ্র ফেওয়া লেক আর মূল সম্পদ অনাবিল প্রকৃতি। আবহাওয়া পরিস্কার থাকলে সারা শহর জুড়ে হিমালয়ের তুষারধবল শিখরগুলি এখান থেকেই দেখা যায়---- মচ্ছপুছারে, ধৌলাগিরি, অন্নপূর্ণা ইত্যাদি পর্বতমালা। রঙ বেরঙের বোটে বোটিং করতে করতে ফেওয়া লেকের জলে ভাসে উল্টোনো মাছের প্রতিকৃতি, মচ্ছপুছারে চূড়াটি।

পারমিট সংগ্রহ | Annapurna Circuit Area Permit

৪ ঠা নভেম্বর সকালে স্নান-জলখাবার সেরে প্রথম কাজ ট্রেকিংয়ের জন্য পারমিট সংগ্রহ করা। পোখরার  উচ্চতা বেশি নয় ঠান্ডাও তেমন নেই নভেম্বরেও , বেশ আরামদায়ক। সকাল-সন্ধ্যা হালকা শীতবস্ত্রে কাজ চলে যায়। রোদ্দুর উঠে গেলে সেটাও আর লাগছে না। পারমিটের জন্য ১ কিমি  মতো হাঁটাপথে যেতে হবে ACAP অফিস। অফিস খোলে ১০-টার সময়। সঙ্গে চারকপি করে ফটো, ভোটার কার্ডের জেরক্স দুকপি করে, ছোটদের আধার কার্ডের জেরক্স। দুটো করে ফর্ম ভরতে হবে। TIMS এর অফিস থেকে ৬০০ টাকা লাগবে ট্রাভেল ইন্স্যুরেন্স করাতে। আর অন্নপূর্ণা সার্কিট এরিয়া পারমিটের (ACAP) জন্য লাগবে ১০০০ টাকা। কোনো মেডিক্যাল ইন্স্যুরেন্স নম্বর বা লাইফ ইন্স্যুরেন্স নম্বরও লিখতে হয় ফর্মে। এই ACAP অফিসেও কিন্তু ভারতীয় টাকা চলে না। জনপ্রতি ১৬০০ নেপালী টাকা দিতে হবে সবমিলিয়ে।

ghandruk ABC

ঘানদ্রুকের পথে | Way to Ghandruk from Baglung Bus Stand

পারমিট সংগ্রহ করে হোটেল ফিরে চেকআউট করে  ট্যাক্সি নিয়ে পৌঁছলাম বাগলুঙ বাসস্ট্যান্ড। বাড়তি লাগেজ হোটেলেই রেখে এসেছি।  ফেরার সময় এখানেই এক রাত থাকবো আবার। বাগলুঙ বাসস্ট্যান্ড যাওয়ার ভাড়া ৪০০ টাকা। আর বাসস্ট্যান্ড থেকে বাসের টিকিট ভাড়া ৫০০ টাকা। দুপুর দু-টোয় বাগলুঙ থেকে ঘানদ্রুক যাওয়ার বাস ছাড়ে। পৌঁছয় সন্ধ্যা ৬-টা নাগাদ। দূরত্ব খুব বেশি নয় তবে পাহাড়ি লোকাল বাস যেমন যায় ধীরে সুস্থে জিনিসপত্র তুলতে নামাতে সময় লাগে। দূরত্ব প্রায় ৫৫ কিমি। নয়াপুল, বিরেথান্টি পর্যন্ত রাস্তা ভালো তারপর ১০ কিমি রাস্তা খুবই খারাপ। এই রাস্তাটুকু বাস প্রায় দুলতে দুলতে চলছে। এই রাস্তাটা যেতেই অনেক সময় লেগে যায়। কিছুদিন আগেও ঘানদ্রুক ট্রেকরুটই ছিল। এখন বাস/জিপ চলছে। খুব শীঘ্রই ঘানদ্রুক আরো জনপ্রিয় ট্যুরিস্ট স্পট হয়ে উঠতে চলেছে। সাবেকি নেপালী গ্রাম, গুরুং মিউজিয়াম, গুরুং ট্রাডিশনাল ড্রেস আর অনাবিল প্রকৃতির আকর্ষণ নেপালীদের মধ্যেও বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে তা বাসভর্তি ট্যুরিস্ট দেখলেই বোঝা যাচ্ছে। বিশেষ করে উইকএন্ড ডেস্টিনেশন হিসাবে। ট্রেকরুটে না গেলেও পোখরা থেকে ঘানদ্রুক ঘুরে একদিন ঘানদ্রুকে থেকে আবার পোখরা ফিরে আসা যায়। শেয়ার ট্যাক্সিতেও চলছে। বাগলুঙ থেকে ট্যাক্সি ছাড়ে না, ট্যাক্সিস্ট্যান্ড অন্য জায়গায়। আর ভাড়া ৭০০ টাকা জনপ্রতি, ১০ জনের সিট। 

Ghandruk Annapurna Guest House

অপরূপা ঘানদ্রুক

পথের দৃশ্য অনবদ্য। আবহাওয়া খুবই পরিস্কার। সপার্ষদ অন্নপূর্ণা, মচ্ছপুছারে শৃঙ্গ পোখরা থেকেই আমাদের সঙ্গী। যত এগোই আরো কাছে চলে আসে। বাস থেকেই সূর্যাস্তের দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হলাম।

 ঘানদ্রুক বাসস্ট্যান্ড থেকে কিছুক্ষণ সিঁড়ি দিয়ে ওঠার পর গুরুং কটেজ। এখন পিক-সিজন আর উইকএন্ড বলে জায়গা পেলাম না। ওনারাই ঠিক করে দিলেন একটু ওপরে অন্নপূর্ণা গেস্ট হাউস। অসাধারণ লোকেশন, ঘরে বসেই অন্নপূর্ণা-সাউথ , হিউনচুলি, গঙ্গাপূর্ণা, ফিশটেইলের বাকরোধ করা দৃশ্য উপভোগ করা যায়। এখান থেকে সূর্যোদয়-সূর্যাস্তের দৃশ্যও মনে রাখার মতো। 

অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্প ট্রেকিং খরচ 

ঘরভাড়া ১৫০০ নেপালী টাকা। খাওয়া আলাদা। এছাড়া থাকা-খাওয়া প্যাকেজ হিসাবেও করে নেওয়া যায় ১২০০-১৫০০ জনপ্রতি, ভেজ-ননভেজ হিসাবে কম-বেশি। ঘানদ্রুক থেকেই ভারতীয় টাকা নিতে চায় না। প্রায় জোর করেই হোটেলে ১০০ টাকা দিয়েছি। গুরুং কটেজে তাও চলে না, অর্থাৎ ভারতীয় টাকা অচল। তাই পোখরা ছাড়ার পর থেকে ট্রেকরুটে যা খরচ হবে সবটাই নেপালী টাকা থাকলে ভালো হয়। সঙ্গে অতিরিক্ত কিছু ভারতীয় ১০০ টাকার নোট। বাস-জিপে ভারতীয় টাকা নিয়ে নেয়, ৫০০ টাকাও নিয়েছে। 

আমাদের ট্রেকপথের শুরু ঘানদ্রুক থেকে | ABC Trek route from Ghandruk 

বেশ বড়োসড়ো নেপালী গ্রাম ঘানদ্রুক। উচ্চতা ১৯৫০ মিটার। অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্পের অন্যতম প্রবেশদ্বার। এছাড়া কান্দে-টোলকা-ফেরি/ লানদ্রুক/ঝিনুদাঁড়া থেকেও এই ট্রেক শুরু করা যায়। পুনহিল সমেত করলে উল্লেরি/ঘোরেপানি থেকে ট্রেকটি শুরু হয়। এক্ষেত্রে প্রায় ১১০ কিমি হাঁটাপথ যাওয়া-আসা নিয়ে। আরো তিন-চারদিন বেশি সময় লাগবে। আমরা ঘানদ্রুক থেকে শুরু করছি এক্ষেত্রে হাঁটাপথের দূরত্ব ৬৯ কিমি। আর সব থেকে কম দূরত্ব ঝিনুর নতুন ব্রীজ পেরিয়ে চোমরঙ দিয়ে, ৬২ কিমি যাতায়াত সমেত। আমরা ঘানদ্রুক-কোমরঙ দিয়ে শুরু করছি তাই ৭ কিমি বেশি হাঁটাপথ। শেষ করবো ঝিনু ব্রীজ পেরিয়ে ঝিনু বাস/জীপস্ট্যান্ডে। সেখান থেকে পোখরা। এক্ষেত্রে যাওয়ার সময় ৩৮ কিমি, ফেরার সময় ৩১ কিমি হাঁটতে হবে।

আমি এই ট্রেকরুটের ডিটেইলস সম্বন্ধেই বেশি আলোচনা করেছি, এই পথে যাওয়ার জন্য যেটা জরুরী। পথের সৌন্দর্য্যের কোনো তুলনা হয়না। আমার জীবনে সেরা ট্রেক তো বটেই সারা পৃথিবীতে অন্যতম সেরা ট্রেকরুট এটি। তাইতো সারা পৃথিবীর মানুষ ছুটে চলেছে এই পথে। প্রতিটি জায়গা ছবির মতোই সুন্দর। মনে হয় সব জায়গায় থাকতে থাকতে যাই। ফুল দিয়ে সাজানো টি-হাউসগুলি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন।  বিলাসবহুল নয়, এপথে হওয়ার কথাও নয় কিন্তু দিনের শেষে ধবধবে সাদা বিছানা দেখেই শান্তি লাগে। আবার ট্রেকরুটের নিরিখে থাকা-খাওয়ার আয়োজন বিলাসবহুল ও বটে! সব জায়গায় থাকতে গেলে ১০-১২ দিন লাগবে। 

চলবে....

অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্প, নেপাল পর্ব ২

1 মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
নবীনতর পূর্বতন