অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্প ট্রেকিং , নেপাল পর্ব-৩ | Annapurna Base Camp Trek, Nepal Part III

 
Annapurna Base Camp

নমস্তে অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্প । আজকের গন্তব্য মচ্ছপুছরে বেস ক্যাম্প | Machhapuchhre Base Camp , ABC Trek ,Nepal

ডোভানের উচ্চতা ২৫২০ মিটার। ৭ ই নভেম্বর। জলখাবার সেরে এগিয়ে যাই সামনে। চোমরঙের ACAP অফিস আর ডোভানের একজন গেস্ট বলেছেন ডোভান থেকে মচ্ছপুছরে বেস ক্যাম্প (MBC) একদিনে না যাওয়াই ভালো। দেউরালিতে থেকে পরদিন সোজা অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্প (Annapurna Base Camp)। নাহলে MBC তে থেকেও দিনে দিনে ABC (Annapurna Base Camp) ঘুরে ফিরে আসা যায়। কিন্তু আমাদের ইচ্ছে তা নয়।  MBC, ABC  দু-জায়গাতেই থাকার ইচ্ছা। তাই একটু আগে বেরোবো ভেবেও আট'টা বেজেই গেল। আসলে জলখাবার খেয়ে বেরোতেই দেরীটা হচ্ছে।  টি-হাউসে সকাল ছ'টায় চাইলেও জলখাবার দিয়ে দেয় কিন্তু খাওয়া যায় না অত সকালে। আবার খারাপও লাগে, থাকবো অথচ খাবো না। এই উচ্চতায় এমন পরিবেশে এসব ভালোও লাগে না। ওনাদের কথাটাও আমাদের ভাবা দরকার। সবই তো পনি মারফৎ ওঠে আর নাহলে মানুষের পিঠে।

অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্প, নেপাল-পর্ব ১
 

অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্প, নেপাল পর্ব ২

ডোভান থেকে দেউরালি | Dovan to Deurali , ABC Trek Route , Nepal

ডোভান থেকে কিছুটা এগিয়েই বেশ সুন্দর একটি জলপ্রপাত, অনেকগুলি ধারায় নেমে এসেছে পাহাড়ের গা বেয়ে, ঝরে পড়ছে মোদিখোলার বুকে। একটি ছোট মন্দির। এখানে কিছুক্ষণ দাঁড়াতেই হবে ছবি তোলার জন্য। এখান থেকে রোদের তীব্রতা আর গায়ে লাগেনা, বেশ আরাম লাগে। বেশিরভাগ পথও সুনিবিড় ছায়াঘেরা। অনেকগুলি ছোট ছোট ঝরণা পেরিয়ে পথ চলতে হচ্ছে। আরো খানিকটা উঠে হিমালয়া, উচ্চতা ২৯২০ মিটার। এরপর বোল্ডার আর ঝুরো মাটির চড়াই রাস্তা। বোঝা যাচ্ছে, আমরা উচ্চ হিমালয়ে প্রবেশ করছি। ধীরে ধীরে সাবধানে পা ফেলে এগিয়ে চলা। এরকম বেশ অনেকক্ষণ ওঠার পর হিঙ্কু-গুহা। সামনেই পাহাড়ের খাঁজে, গায়ে মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। হু হু করে ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে। মনে হয়, কিছুটা সময় বসে যাই। কিন্তু সন্ধ্যের আগে গন্তব্যে পৌঁছতে হবে তাই আর দেরী নয়। ডোভান থেকে হিমালয়া, হিমালয়া থেকে দেউরালি ৪ কিমি করে মোট ৮ কিমি। এবার নীচে নেমে দেউরালির  শুরু। দেউরালিও সিনুয়ার মতো অনেকটা ছড়ানো। তবে থাকার জায়গা মাত্র চারটে। ভূ-প্রকৃতিও বদলে যাচ্ছে ক্রমশঃ। ঠান্ডা হাওয়ার দাপট, ল্যান্ড-স্লাইড জোন পেরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। কিছুদিন পর এখান থেকে বরফে রাস্তা বন্ধ হয়ে যাবে ওপরে যাওয়ার। দেউরালির উচ্চতা ৩২০০ মিটার অর্থাৎ ১০,৫০০ ফুট।

বাকরোধ করা পথ

হিমালয়ার পর থেকে পথের বৈচিত্র্য, সৌন্দর্য্য চোখে পড়ার মতোই। একেবারে বাকরোধ করা পথ, পথের শোভা। দেউরালি পেরিয়ে আবার নীচে নামা। একবারে গহীন অতলে তলিয়ে এক গভীর সুন্দর গিরিখাত। সুন্দরী মোদিখোলার পাশ দিয়ে পথ। একদিকে নদীর ঝরঝর কলকল করে বয়ে চলা আর একদিকে রুক্ষ, ন্যাড়া পাথরের গুরুগম্ভীর রূপ। গাছপালা কমে গেছে। এতটা নেমে আবার উঠতে হবে ভেবে গতি আরো শ্লথ হয়ে যায়। ফেরার সময় আবার এপথে উঠে দেউরালি। আসলে কষ্ট ক্লান্তি সবারই হয় কিন্তু তার বদলে যা পাই তা সব কষ্ট ছাপিয়ে যায়। মনে হয় এর বেশি আর কি চাই! 

MBC (মচ্ছপুছরে বেস ক্যাম্প)

হিমালয়া হয়ে দেউরালি থেকে MBC (মচ্ছপুছরে বেস ক্যাম্প)

 দেউরালি থেকে MBC ৫ কিমি। এপথের এটাই চাপ---- এই সিঁড়ি আর বার বার নেমে আবার ওঠা। সাধারণ হাঁটা রাস্তা নয়। গিরিখাত পেরিয়ে আবার ওঠা। দূর থেকে দেখতে পাই MBC'র টি-হাউসগুলি। বার বার দাঁড়িয়ে বিশ্রাম নেওয়া, টুকটাক খাওয়া, ছবি তোলার জন্য সন্ধ্যে নেমে আসে। তবে আগামীকাল পূর্ণিমা বলে চাঁদের আলোয় হাঁটতে অসুবিধা হয় না। সঙ্গে টর্চও আছে, অবশ্যই সঙ্গে টর্চ রাখা উচিত। পাহাড়ের মাথায় জ্বলজ্বল করছে সন্ধ্যাতারা।  ছবি তোলার ব্যর্থ চেষ্টা করি লাভ হয়না কিছু, যা দেখি সবই কি আর দেখানো যায়! অদ্ভুত মায়ায় ঘেরা প্রকৃতি কিন্তু গন্তব্যে পৌঁছনোর তাড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা যায় না বেশিক্ষণ। এইসব মুহূর্তগুলোই সারা জীবনের সঞ্চয়। 

MBC পৌঁছনোর আগে একটা narrow-ridge আছে, ওটা পেরিয়ে ঢুকে পরি গঙ্গাপূর্ণা গেস্ট হাউসে। অবশেষে পৌঁছলাম! কি যে স্বস্তি! এবার অভীষ্ট লক্ষ্যের একদম কাছে।    

অনেকদিন ধরে লালন করা, স্বপ্নে দেখা একটা সাধ পূর্ণ হতে চলেছে। 

উচ্চতাজনিত-অসুস্থতার কবলে (altitude-sickness)

 আমরা রাতের খাবার খেতে বসেছি। এমনসময় একটি মেয়ে এসে বলে, নীচে ওদের দলের আর একটি মেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছে, অল্টিটিউড-সিকনেস। একেই রাত হয়ে গেছে, ঠান্ডায় এই অবস্থা। ওনাদের এই গেস্ট-হাউসেই আনা হয়। প্রাথমিক চিকিৎসার পর সুস্থ হন। প্রাথমিক চিকিৎসা বলতে---- গরমজল/চা/কফি পান করা। হাত-পায়ের তলা গরম করা। গার্লিক/রসুন সুপ খাওয়া ইত্যাদি। অর্থাৎ যে কোনো উপায়ে শরীর গরম রাখা। শরীরকে উচ্চতার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্য তাড়াহুড়ো করলেও সমস্যা। বুকে চাপ লাগলে কিছুক্ষণ বসে বিশ্রাম নিয়ে আবার হাঁটা। এপথের এটাই দস্তুর, দিনের আলো থাকতে থাকতে গন্তব্যে পৌঁছে যাওয়ার চেষ্টা করা। 

Annapurna Base Camp Trek, Nepal Part III

মচ্ছপুছরে-বেস-ক্যাম্প (MBC) | Machhapuchhre Base Camp 

রাতে চাঁদের আলোয় ঝকঝক করছে অন্নপূর্ণা-১, গ্লেসিয়ারডোম, গঙ্গাপূর্ণা, গন্ধর্বচুল্লি, মচ্ছপুছরে শৃঙ্গগুলি। চলে চাঁদ আর মেঘের খেলা। কিন্তু ঠান্ডার তীব্রতায় বেশিক্ষণ বাইরে থাকা যায় না। পাহাড়ের খাঁজে ঘন মেঘ জমাট বাঁধতে থাকে, যেন পাহাড়-উপত্যকা তন্দ্রাচ্ছন্ন। আরো রাত বাড়লে নির্মেঘ আকাশে চাঁদ আর চাঁদের আলোয় ভাস্বর তুষার শৃঙ্গগুলি।

 পাহাড়ের ঘুম তাড়াতাড়ি ভাঙে  কিন্তু উপত্যকায় রোদ্দুর পৌঁছতে  ৮ টা বেজে যায়। মচ্ছপুছরে-বেস-ক্যাম্পের উচ্চতা ৩৭০০ মিটার। আজ আর তেমন তাড়া নেই। ৩ কিমি পথ যেতে হবে। তাও দু-ঘন্টার বেশিই লেগে যাবে। গিয়ে আবার থাকার জায়গা দেখতে হবে, সেই চিন্তাটা আছেই। কারণ অন্নপূর্ণা-বেস-ক্যাম্পে বেশ ভিড়। এক্ষেত্রে MBC তে থাকলে কিছুটা সুবিধাও কাছাকাছি বলে। ৮ ই নভেম্বর।আজ পূর্ণিমা! বেলা দশ'টা নাগাদ MBC ছাড়িয়ে এগিয়ে  যাই ABC র দিকে। গাছপালাহীন অঞ্চল, অক্সিজেন কম তাই ধীরে সুস্থে এগিয়ে চলা। সোনালী ঘাসের মধ্যে দিয়ে পথ। চারপাশে গোল করে ঘিরে আছে তুষারশৃঙ্গের সারি। মচ্ছপুছরে শৃঙ্গকে পিছনে রেখে এগিয়ে যাই। বার বার দাঁড়াতে হয় ছবি তোলার জন্য। ঘন নীল আকাশ, নীচে সোনালী ঘাস আর চারদিকটা রূপোর মতো ঝলমল করছে। অনেকদূর থেকেই অন্নপূর্ণা-বেস-ক্যাম্পের টি-হাউসগুলি দেখা যায় অন্নপূর্ণা-সাউথের কোল ঘেঁষে। 

Annapurna Base Camp Trek, Nepal Part III

অন্নপূর্ণা-বেস-ক্যাম্প (ABC)

"নমস্তে অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্প" লেখা ফলক পেরিয়ে এগিয়ে যাই টি-হাউসগুলির দিকে। খুব ভিড় এখানে। সব টি-হাউসগুলি ভর্তি। মচ্ছপুছরে গেস্ট হাউসের টিনের ছাউনি দেওয়া আট-বেডের একটি ঘর শেয়ারে থাকার জায়গা পাই। আমরা তিনজন, আরো পাঁচজন বিদেশী বিভিন্ন দেশ থেকে এসেছেন। থাকা-খাওয়া জনপ্রতি ২০০০ টাকা। wifi, ফোন-ক্যামেরা চার্জ, গরমজল, দুবার চা সব এরমধ্যেই ধরা আছে। চোমরঙ থেকেই সব টি-হাউসে বাইরে কমন-টয়লেট, একবারে ঝকঝকে তকতকে। ঘরের কম্বল-বিছানাও নতুনের মতো পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন। অনেকেই ঘর না পেয়ে বা শেয়ারে থাকতে রাজি নয় বলে ফিরে যাচ্ছেন MBC। ডাইনিং হলেও গদি পাতা আছে, ঘরের অভাবে এখানেও রাত কাটানোর ব্যবস্থা করা আছে।  

অবিস্মরণীয় দিন ও রাত

একটা রাত যেভাবে হোক ঠিকই কেটে যাবে কিন্তু এখানে না থেকে ফিরে গেলে এমন সূর্যাস্তের বিকেল, পূর্ণিমার রূপো গলানো রাত,  সূর্যোদয়ের ভোর এ-জীবনে  আর হয়তো আসবেনা। যে অপার্থিব দৃশ্যের জন্য এতদূর আসা। আর ভুললে চলবে না এটা ট্রেক রুট। যা পাচ্ছি সেটাও অনেক। হাতে গরম চায়ের কাপ নিয়ে মচ্ছপুছরের  বুকে অস্তরাগের যে বিকেল তা সারাজীবনেও ভোলার নয়। জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিকেল, শ্রেষ্ঠ সূর্যাস্তের বিকেল।

সূর্যাস্তের পর থেকেই সময় কাটে টি-হাউসের ডাইনিং হলে বসে। মনে হয় এই ডাইনিং হলটাই গোটা পৃথিবীর ক্ষুদ্র সংস্করণ। এই ট্রেক রুটে এও এক বৈচিত্র্য, উপরি পাওনা। এত কাছ থেকে ক-ত দেশের মানুষ দেখা। 

ঘুম সারারাত প্রায় হয়না। মাঝরাতে বাইরে বেরিয়ে দেখি চাঁদের আলোয় ঝলমল করছে ৩৬০ ডিগ্রি জুড়ে ঘিরে থাকা নামী নামী সব তুষারশৃঙ্গের দল। আবার ছবি তোলার ব্যর্থ প্রচেষ্টা। মন চায় অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখি এই অপার্থিব দৃশ্য। কিন্তু শীতের কামড়ে ঘরের উষ্ণতায় ঢুকতে বাধ্য হই। অন্নপূর্ণা-বেস-ক্যাম্পের উচ্চতা ১৪৩০ মিটার , প্রায় ১৩,৫৫০ ফুট।

জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সকাল

সূর্যাস্ত যেমনি রাজকীয়, এখান থেকে দেখা সূর্যোদয়ের দৃশ্যেরও তুলনা মেলা ভার। গোলাপী, লাল, কমলা, গলানো সোনা গড়িয়ে নামে অন্নপূর্ণার গা বেয়ে। উল্টোদিকেও আকাশে রঙের খেলা চলে। MBC থেকে অনেকেই অন্ধকার থাকতে বেরিয়ে পড়েন ABC'র উদ্দেশ্যে। লাইন দিয়ে লোকজন আসছে দেখা যাচ্ছে। কারোর কারোর হেড-টর্চগুলি জ্বলছে আবছা অন্ধকারে। অন্নপূর্ণা-১, ২ ;  অন্নপূর্ণা-৩, ৪; অন্নপূর্ণা-সাউথ, অন্নপূর্ণা ফ্যাং (বরাহ শিখর), টেন্ট-পিক,  গঙ্গাপূর্ণা, মচ্ছপুছরে, হিনচুলি সোনালী আলোয় উদ্ভাসিত। প্রবল কনকনে ঠান্ডায় ঈশ্বরের আশীর্বাদের মতোই উপত্যকা রোদে ভরে ওঠে। উষ্ণতার পরশ পাই। ঈশ্বরকে, প্রকৃতিকে, হিমালয়কে অনেক প্রণাম এই আশীর্বাদ বর্ষণ করার জন্য। এ-জীবনে প্রকৃতির এমন রূপ চাক্ষুষ করানোর জন্য। আমাদের  অনেকদিন ধরে প্রায় চার বছর ধরে লালন করা একটা স্বপ্ন আজ পূর্ণ হলো, জীবন ধন্য।

জলখাবার সেরে ফিরে চলি। আরো একদিন থাকলে ভালো হয় কিন্তু দিনও হাতে গোনা। ছুটির অভাব। এই পথে যত বেশি দিন নিয়ে আসা যায় ততই লাভ। 

চলবে.. 

অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্প, নেপাল- শেষ পর্ব
  

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন