মায়াপুর ভ্রমণ মায়াপুর ইসকন মন্দির| Mayapur Iskcon Travel
পয়লা জানুয়ারি, নতুন বছরের সকাল। আমরা সপরিবারে চলেছি মায়াপুরের উদ্দেশ্যে। আমরা মোট ৮ জন, একটি কোয়ালিশ গাড়ি ভাড়া করে নিয়েছি। সকাল ৬ টায় বেরোনোর কথা হলেও গাড়ি আসতে দেরী করায় বেরোতে বেরোতে ৮ টা বাজলো। শ্রীরামপুর থেকে মায়াপুরের দূরত্ব প্রায় ১০০ কিমি। কোথাও না দাঁড়িয়ে টানা গেলে ৩ ঘন্টা সময় লাগে। নদীয়া জেলায় অবস্থিত মায়াপুর বিখ্যাত ইস্কন মন্দিরের জন্য। শ্রী চৈতন্যদেবের জন্মস্থান নবদ্বীপ ধাম। এখানে জলঙ্গী নদী মিশেছে গঙ্গা নদীতে।
সোমরাবাজারে চা-বিরতি
দিল্লী রোড পেরিয়ে মগরা, আদিসপ্তগ্রাম হয়ে ছুটে চলেছি। আদিসপ্তগ্রাম আর কালনার মাঝে সোমরাবাজারে রাস্তার ধারেই ঘোষের স্পেশাল চা এর দোকানে দাঁড়াই ৯ টা নাগাদ। আজ রোদ্দুর ওঠেনি, এখনো ধোঁয়াশা। চায়ের দোকান হলেও এখানে পরোটা, আলুরদম, ঘুঘনি, মুড়ি, ডিমভাজা সবই পাওয়া যায় আর চা ও দারুণ।
গুপ্তিপাড়া-শান্তিপুর হয়ে মায়াপুর
এরপর আমরা কালনার দিকে না গিয়ে ইচ্ছে করেই গুপ্তিপাড়ার পথ ধরলাম। এখানে গাড়ি-লরী সমেত নদী পারাপার হয়। আমরা গাড়িতে বসেই গঙ্গানদী পেরিয়ে ওপারে শান্তিপুর পৌঁছে গেলাম। সবমিলিয়ে ভাড়া ১৩০ টাকা। কিছুক্ষণ পর আমরা মূল রাস্তায় এসে এন-এইচ-১২ (NH-12) ধরে এগিয়ে চললাম মায়াপুরের দিকে। আর একঘন্টার পথ। ফেরার সময় শান্তিপুরের দিকে না গিয়ে নবদ্বীপ কালনার দিক দিয়ে ফিরব। এই পথটাই বেশি সহজ ও সুবিধাজনক।
মায়াপুরের ইস্কন-মন্দিরে প্রবেশ
আজ বছরের প্রথম দিন, তার ওপর রবিবার, বলাই বাহুল্য যে অসম্ভব ভিড় হবে জেনেই আমরা ইস্কন মন্দিরে আগে থেকেই ঘর বুক করেই এসেছি। গাড়ি পার্কিং করে এগিয়ে যাই ইশোদ্যান ভবনের দিকে। পার্কিং চার্জ ১২০ টাকা।
ইশোদ্যান ভবন মায়াপুর থাকার জায়গা | Ishodyan Bhavan Mayapur
ইশোদ্যান ভবনের দিকটা এখনো বেশ ফাঁকা ফাঁকা। মরসুমী ফুলে ফুলে ভরে আছে চারদিক। বিশেষ করে নানা রঙের চন্দ্রমল্লিকায়।
রিসেপশনে এন্ট্রি করে আমরা দুটো ঘরের চাবি পেলাম ১২০৯ , ১২১০। তিনতলায় আমাদের ঘরদুটো। এখানে লিফ্ট আছে। রিসেপশনের উল্টোদিকেই ইশোদ্যান ভবনের নিজস্ব ডাইনিং বা প্রসাদকক্ষ। এখানে সীমিত পরিমাণ কুপন আছে। দুপুরের আর রাতের খাওয়ার সুবন্দোবস্ত আছে। যারা গদাভবন বা গীতাভবনে মাটিতে বসে খেতে পারবে না এখানে খেতে পারেন, চেয়ার-টেবিলে খাওয়ার ব্যবস্থা।
ইশোদ্যান ভবনে না থাকলেও খাওয়ার কুপন সংগ্রহ করতে পারলে এখানে খাওয়া যায়। দুপুরের জন্য ১৫০ টাকা, রাতের জন্য ১০০ টাকা কুপনের মূল্য। দুপুরে খাওয়ার জন্য সকাল ৭-৮ টায় কুপন দেওয়া শুরু হয় আর রাতের জন্য দুপুর ৩ টে থেকে। আমরা আজ এই ভিড়ের দিনে ইশোদ্যান ভবনে খাওয়ার টিকিট পেলাম না। এই কাউন্টারেই গদাভবনের টিকিট পেলাম। লাইন দিয়ে অনেকটা সময় লাগবে আর মা মাটিতে বসতেও পারবেনা তাই আমরা প্যাকিং-প্রসাদের কুপন কাটলাম ৯০ টাকা দিয়ে। গদাভবন থেকে প্যাকিং-লাঞ্চ এনে আমরা ঘরেই খেয়ে নিলাম।
ঘর আমরা অনলাইনে বুক করেছিলাম। এই ঘরগুলোর ভাড়া সব মিলিয়ে ২১০০ করে। চারজনে থাকা যায়-- দুটো সিঙ্গল বেড আর দুজন নীচে শুতে পারবে, ম্যাট্রেস চাদর বালিশ কম্বল সবই দেওয়া আছে চারজনের থাকার মতো। ঘরে গিজার আছে। রিসেপশনের উল্টোদিকে প্রসাদ-কক্ষের পাশেই গরম-ঠান্ডা-নর্মাল সবরকম পানীয় জলের ব্যবস্থা আছে। দুপুরে রাতের খাবারের কুপন কেটে রাখলাম। দুপুরে ১ টা থেকে ২ টো আর রাত ৮ টা থেকে ৯ টা খাবার/প্রসাদ পরিবেশন করা হয়। এইসময় বা নিয়ম সব ভবনের জন্যই প্রযোজ্য-- গীতাভবন, গদাভবন, ইশোদ্যান ভবন। রিসেপশনের কাউন্টারে কথা বলে হুইল-চেয়ারও পাওয়া যায় ফ্রী-তে। এক্ষেত্রে ১০০০ টাকা ডিপোজিট রাখতে হবে।
আরও পড়ুনঃ গনগনি, গড়বেতা পশ্চিম-মেদিনীপুর ভ্রমণ
ইস্কন-মন্দিরে অন্যান্য ভবন (মায়াপুর থাকার জায়গা)
আমাদের গাড়ির ড্রাইভার দাদার থাকার ব্যবস্থা হল চৈতন্য ভবনে। ঘর ভাড়া ৪০০ টাকা। এছাড়াও নিত্যানন্দ কুটির, গৌরাঙ্গ কুটিরেও সুলভ মূল্যে থাকা যায়। শ্রুতি ভবন সাধারণত ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য বা যারা একটু বেশিদিন থাকবেন তাদের জন্য ভালো। এখানে কমন বাথরুম। শঙ্খ ভবন, ইশোদ্যান ভবন, গদা ভবনের অনলাইন বুকিং হয়। এইসবের মধ্যে শঙ্খ ভবন একদম মন্দিরের সামনে আর এখানে থাকার চার্জ সবচেয়ে বেশি। আমরা বিকেলে বেরিয়ে গোশালার দিক থেকে ঘুরে এলাম। এদিকেই শ্রুতি ভবন, নিত্যানন্দ কুটির, গৌরাঙ্গ কুটিরগুলি। গরুতে টানা গাড়ি করে গোশালা ঘুরে আসা যায়।
শ্রী শ্রীল প্রভুপাদের সমাধি মন্দির
গোশালা থেকে ফিরে গেলাম ইস্কন মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা শ্রীল প্রভুপাদের সমাধি মন্দির। সমাধি মন্দিরের প্রভুপাদের সোনার মূর্তি।বিশাল এই মন্দিরে ঘুরে ঘুরে ওপরে ওঠা যায়। মন্দিরের দোতলায় শ্রী শ্রীল প্রভুপাদের ঘর ও ব্যবহৃত জিনিস আছে। ১৫ টাকা করে টিকিট। এখানে কোথাওই মন্দিরের ভেতর ছবি তোলা যায় না। ফোন/ক্যামেরা জমা দিয়ে ভেতরে ঢুকতে হয়, চন্দ্রোদয় মন্দিরেও তাই। এখানে আরো একটি বিশাল মন্দির স্থাপিত হচ্ছে, অনেকদিন ধরেই কাজ চলছে। সমাধি মন্দির দেখে বেরিয়ে এসে একটা দোকানে চা পেলাম, ১০ টাকায় আদা-এলাচ দেওয়া দুধ চা। আর কোথাওই মন্দির চত্বরে চা পাওয়া যায় না। গোবিন্দা রেস্টুরেন্টে ভেষজ চা পাওয়া যায় আদা চা, লেবু চা ইত্যাদি ৩০ টাকায়।
চন্দ্রোদয় মন্দির ও সন্ধ্যা-আরতি
এরপর আমরা প্রবেশ করলাম মূল মন্দিরে অর্থাৎ চন্দ্রোদয় মন্দিরে সন্ধ্যারতি দেখতে। ৬ টা থেকে শুরু হয় সন্ধ্যারতি। ভিড় ঠেলে ঢুকে ভালোভাবেই দর্শন হল রাধাকৃষ্ণের মোহনমূর্তি। এই নিয়ে তিনবার মায়াপুরের ইস্কন মন্দিরে এলাম।প্রথমবার বিগ্রহের রূপ, সাজসজ্জা দেখে চোখ ধাঁধিয়ে গিয়েছিল! যতবার দেখি ভালো লাগে। এখানে রাধাকৃষ্ণের মূর্তি আছে অষ্টসখী সমেত, পঞ্চতত্ত্বের মূর্তি অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণের পাঁচজন অবতার, নৃসিংহদেবের মূর্তি, জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রার মূর্তি ও শ্রীল প্রভুপাদের মূর্তি বিরাজমান এই মন্দিরে। নাম-কীর্তনসহ সকাল সন্ধ্যায় আরতি দেখার মতোই। এক অদ্ভুত বাতাবরণ সৃষ্টি হয়, যা মন ছুঁয়ে যায়। আরতির সময় যা ভিড় ছিল এক-দেড়ঘণ্টা পর অনেকটা ফাঁকা হয়ে গেল। মন্দির খোলা থাকে রাত ৮-৩০ টা পর্যন্ত। আমরা ইশোদ্যান ভবনে গিয়ে রাতের খাবার সেরে ঘরে চলে যাই। খুবই ক্লান্ত তাই তাড়াতাড়ি শুয়ে পরি। আবার ভোরে উঠতে হবে মঙ্গল আরতি দেখার জন্য।
মঙ্গল-আরতি
মঙ্গল আরতি শুরু হয় ভোর ৪-৩০ থেকে। বাইরে জুতো জমা দিয়ে ঢুকে পরি মন্দিরে। গতকালের মতো অত ভিড় নেই। নাম-সংকীর্তনে মেতে উঠি সবাই। গতকালের বেশভূষণ বদলে অন্য পোশাক পরানো হয়েছে বিগ্রহদের। অপূর্ব-মনোমুগ্ধকর রূপ!
শৃঙ্গার-আরতি
এরপর শৃঙ্গার আরতি হয় সকাল ৭ টার সময়, এইসময়ও আবার বিগ্রহদের পোশাক বদলে রাজবেশ পরানো হয়েছে--- সত্যিই দেখার মতোই।এইসময় মন্দির সবচেয়ে ফাঁকা থাকে তুলনামূলকভাবে। সন্ধ্যারতির সময় আর এই সকাল ৭ টার আরতির সময় হাতিদের আনা হয় মন্দিরের সামনে। গতকাল ভিড়ের জন্য বোধহয় আনা হয়নি। হাতির পিঠে করে রাধামাধব স্নান সেরে ফেরেন শৃঙ্গার আরতির সময়। সবটাই স্ক্রিনে লাইভ টেলিকাস্ট করা হয়।
ফেরার পালা
ইশোদ্যান ভবনে সকাল ৯ টায় চেক-ইন এবং চেক-আউট করার সময়। আমরা ঘরে গিয়ে তৈরি হয়ে ব্যাগপত্তর নামিয়ে নীচে চলে আসি। এখানে সামনেই ICICI ব্যাংকের ATM ও আছে।এখানে গোবিন্দা রেস্টুরেন্টে আমরা জলখাবার সেরে এগিয়ে যাবো বাড়ির পথে। গোবিন্দা রেস্টুরেন্টে যাওয়ার রাস্তায় মন্দির চত্বরের মধ্যেই একজায়গায় গোলাপী ডেইজি ফুলে ভরে আছে, বলা যায় জঙ্গল হয়ে আছে এই সময়, খুবই সুন্দর লাগছে। গোবিন্দা রেস্টুরেন্টে আমরা মশালা ধোসা নিলাম, ৮০ টাকা করে। এছাড়া পাস্তা, পেস্ট্রি, পোহা, পরোটা ইত্যাদি পাওয়া যাচ্ছে। এখানে কিন্তু বেলা ১০ টার পর ব্রেকফাস্টের অর্ডার আর নেওয়া হয় না, অনেককেই দেখলাম এসে ফিরে যাচ্ছেন। এবার আমাদেরও বাড়ির পথে ফেরার পালা।
মায়াপুর ইসকন মন্দির কখন যাবেন
সারা বছরই যাওয়া যায়। তবে দোলযাত্রা, জন্মাষ্টমী, রাসযাত্রা, রথযাত্রা ইত্যাদি তিথিতে খুব ভিড় হয়।
মায়াপুর ইসকন মন্দির কিভাবে যাবেন
আমরা এবার বাড়ি থেকে টানা গাড়ি করে এসেছি। ভাড়া ৫৫০০ টাকা সব মিলিয়ে।
আগে একবার হাওড়া-কাটোয়া লোকাল ধরে ট্রেনে নবদ্বীপ এসে, সেখান থেকে অটোতে হুলোরঘাট হয়ে নৌকায় জলঙ্গী নদী পেরিয়ে আবার অটোতে মন্দির পৌঁছেছিলাম। নবদ্বীপধাম রেলস্টেশনের বদলে বিষ্ণুপ্রিয়া স্টেশনে নামলেই মায়াপুর যাওয়া সুবিধা। কিন্তু সব ট্রেন বিষ্ণুপ্রিয়া স্টেশনে দাঁড়ায় না। আর আমরা সেবার নবদ্বীপধামও ঘুরে দেখেছিলাম তাই নবদ্বীপেই নেমেছিলাম।
এছাড়া কৃষ্ণনগর অবধি বাস বা ট্রেনে পৌঁছে, কৃষ্ণনগর থেকে বাস বা অটোতে মায়াপুর।
মায়াপুর হোটেল ভাড়া | Mayapur Room Price
ইস্কন-মন্দির চত্বরে অনেক থাকার জায়গা আছে বিভিন্ন মানের ও বিভিন্ন দামের। ২০০ টাকা থেকে ৫০০০ টাকার ওপরও। visitmayapur.com এ গিয়ে অনলাইনে ঘর বুক করতে পারেন।
মন্দিরের বাইরেও থাকার হোটেল আছে তবে জানিনা কেমন। নবদ্বীপে থেকেও মায়াপুর ইস্কন মন্দিরে ঘুরে নেওয়া যায়।
লাইফ-মেম্বারশিপ যাদের আছে তাদের বংশীভবনে থাকার ব্যবস্থা হয়। এককালীন বোধহয় ৩৫,৫০০ টাকা দিতে হয়। সারা পৃথিবীর যেকোন ইস্কন মন্দিরে চারজনের জন্য তিনদিন থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা হয় বিনামূল্যে। এছাড়া অন্যান্য ভবনেও ডিসকাউন্টে ঘর পাওয়া যায়।
শঙ্খভবন, ইশোদ্যান ভবন, গদাভবন, বংশীভবন, শ্রুতি ভবন, নিত্যানন্দ কুটির, গৌরাঙ্গ কুটির, চৈতন্যভবন, চক্রভবন, গীতাভবন, পদ্ম ভবন, নামহাট্টা ভবন ইত্যাদি।
শঙ্খভবন, ইশোদ্যান ভবন, গদাভবনে অনলাইন-বুকিং (online-booking ) হয়।
গদাভবন ফোন নং (phone no):-
O9474751202
মায়াপুর ইসকন মন্দির যোগাযোগের অন্যান্য নম্বর
03472245240
+918017625379
+916295547507
মায়াপুর ইসকন মন্দিরের ভোগ কুপন
মন্দিরে পৌঁছে প্রথমে ভোগের কুপন কেটে নেবেন। গদাভবন, গীতাভবন, ইশোদ্যান ভবনে দুপুরে এবং রাতে ভোগপ্রসাদ খাওয়ানো হয়।
ইশোদ্যান ভবনে দুপুরের প্রসাদ ১৫০ টাকা, রাতের প্রসাদ ১০০ টাকা। গদাভবনে দুপুরের প্রসাদ ৮০ টাকা, রাতের প্রসাদ ৫০ টাকা। গীতাভবনে আরো একটু কম।
মন্দিরে নিরামিষ খাবার পরিবেশিত হয়। আমীষ খেতে চাইলে মন্দিরের বাইরে হোটেল আছে। এছাড়া বিভিন্ন কাউন্টারে মহাপ্রসাদ কিনতে পাওয়া যায়, কেক-লাড্ডু ইত্যাদি শুকনো প্রসাদ।