নাগাল্যান্ডের জুকু ভ্যালি (DZUKOU VALLEY NAGALAND) ট্রেক | দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব

 জুকু ভ্যালি ভরে যায় জুকু লিলিতে হয়ে ওঠে আরো গাঢ় সবুজ

বৃষ্টির জন্যই বোধহয় রাতে বেশ শীত করছিল ঘুম আসছিল না। ৩১ শে মে, বুধবার সকালে উঠে দেখলাম একটা ব্যাগের পাশে লজেন্স ছিল, কাল ইঁদুরে কেটেছে। সঙ্গে খাবার রাখলে খুব সাবধান। আমাদের সাথে যা অল্প সল্প শুকনো খাবার ছিল সেগুলো আমরা সঙ্গে নিয়েই সারাক্ষণ ঘুরছিলাম ইঁদুরের ভয়ে। ওই খাবার দিয়েই জলখাবার সারলাম আর ম্যাগি খেতে ভালো লাগছিল না। এরপর গেলাম হেলিপ্যাডের দিকে। চারদিকে সবুজে সবুজ। রোদ্দুরে ঝলমল করছে আর বেশ গরমও। নীল ঝকঝকে আকাশ। অসাধারণ লাগছে চারপাশটা। উপত্যকার মধ্যে হু হু করে মেঘ ঢুকছে দু-দিক দিয়ে।

নাগাল্যান্ডের জুকু ভ্যালি (DZUKOU VALLEY NAGALAND) ট্রেক | প্রথম পর্ব

আমরা কটেজের পেছনে রডোডেনড্রনের জঙ্গলে জুকু লিলিরও দেখা পেয়েছি সকালে, এদিকেও দেখলাম জুকু লিলি সমেত আরো বেশ কিছু ফুল। এখনো তেমন ফোটেনি সেভাবে। জুলাই-আগস্টে শুনেছি ভ্যালি ভরে যায় জুকু লিলিতে আর উপত্যকা আরো গাঢ় সবুজ হয়ে ওঠে। এটাই পিক-সিজন জুকু ভ্যালিতে আসার।কিন্তু জুকুর এই সবুজ উপত্যকার মূলে প্রধানতঃ বাঁশ গাছ। এত সবুজ হওয়া সত্ত্বেও এই জমি চাষবাসের উপযুক্ত নয় তাই এই উপত্যকার অপর নাম "soulless valley" অর্থাৎ 'প্রাণহীন উপত্যকা'। একজন বলছিল এখানে অন্য গাছ না হওয়ার মূলেও এই বাঁশগাছ, বাঁশগাছ অন্য গাছ হতে দেয় না। এমনকি জুকু লিলিও কমে যাচ্ছে , তাই ফুলের মরসুমের আগে বাঁশের জঙ্গল পুড়িয়ে দিলে ভালো ফুল হয় নাকি। এই পোড়াতে গিয়েই কিজানি অনেক জায়গাতে প্রচুর বড় গাছও পুড়ে গেছে। এই পোড়াতে গিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে পুলিশ কেস হয়েছে তারপর আর কেউ সাহস পায় না। 

DZUKOU VALLEY NAGALAND


ক্রশ/ জিরো-পয়েন্টের দিকে

হেলিপ্যাড থেকে আরো এগিয়ে যাই ক্রশের দিকে, ক্রশ অর্থাৎ জিরো পয়েন্ট। জুকুর বেশিরভাগটাই দু-পাশে বাঁশগাছের ঝোপ মাঝখান দিয়ে সরু মাটির রাস্তা। হঠাৎ সম্রাট চেঁচিয়ে ওঠে সাপ! সাপ! করে।! আমি প্রথমে ভাবি মজা করছে, পরে ওকে দেখে বুঝলাম সত্যিই! ওর পায়ের সামনে দিয়ে একটা সবুজ রঙের সাপ চলে গেছে। খুবই ভয় পেয়ে গেছে বেচারা। এদের সবার সঙ্গে জুকুতে এসেই আলাপ। পুরো ভ্যালি এক্সপ্লোর করতে হলে ক্রশ অবধি যেতে হবে। মাঝে পড়বে ভূত-গুহা, একটা কালো পাথর রাখা আছে। সারাদিন সূর্যের আলোর সঙ্গে চলে ভ্যালির রঙ বদলের খেলা। ক্রশ অবধি যেতে হলে এক জায়গায় নদী পেরিয়ে যেতে হয় যা কনকনে জল! এইজন্যই বোধহয় জুকু শব্দের অর্থ "ঠান্ডা জল"! সারাদিন ভ্যালিতে ঘুরে বেড়িয়ে বিকেলের আগে ফিরে আসি ক্যাম্পে।

আরো একটা রাত জুকুতে

সারা সন্ধ্যে চলে ওই কলেজ গ্রুপটির গান-বাজনা আর হৈ হৈ। ভালোই লাগে নাহলে সময় কাটে না। জুকু ভ্যালি নাগাল্যান্ড আর মনিপুরের বর্ডার এলাকায় অবস্থিত।  মণিপুরের ওদিকটায় বিদ্যুৎ চমকায় মাঝে মাঝে, এদিকে আকাশ পরিস্কার। আকাশে চাঁদ জ্বলজ্বল করছে। চাঁদের আলোয় উপত্যকা ভরে যায়। কটেজে ঢুকতেই ইচ্ছে করে না। বেশ অনেক রাত অবধি বসে থাকি ভ্যালির দিকে তাকিয়ে। আরো একটা রাত কেটে যায় জুকু ভ্যালিতে। 

ফিরে চলা

মাঝরাতে বা ভোরের দিকে বৃষ্টি হয়। ১ লা জুন,  বৃহষ্পতিবার সকালে আবার রোদ ঝলমলে উপত্যকা। এবার আবার একই পথে সারি সারি পাহাড়ের গা-বেয়ে নীচে নামার পালা। রোদ্দুরে ব্যাগ নিয়ে হাঁটতে কষ্টই হয় তবে আজ মাঝে মাঝে মেঘলা করে আসে আর কোথা থেকে মেঘের দল ঢেকে দিয়ে যায় আমাদের। আবার উড়ে চলে যায় উপত্যকার দিকে। একটা ঠান্ডা আমেজে ভরিয়ে দিয়ে যায় কি আরাম যে লাগে! মনে হয় দু-হাত ছড়িয়ে উপভোগ করি এই মুহুর্তটুকু ! টুকরো টুকরো মেঘের ভেলা ভেসে বেড়ায় উপত্যকাজুড়ে। ভাবি এইবার বুঝি বৃষ্টি হবে।  এক-দুফোঁটা গায়ে জল পড়লেও বৃষ্টি তেমন হয়না।

রোবি দিদি বলেছিল টাওয়ার পেলে ফোন করে গাড়ির জন্য বলতে। আমরা হিল টপে পৌঁছে টাওয়ার পেতেই গাড়ি পাঠাতে বললাম আর বললাম দুপুরের খাবার রাখতে। সিঁড়ি দিয়ে নামতে আরো ঘন্টা-খানেক লেগে যায়। এরপর গাড়িতে একঘন্টা।

দুপুরে ডিম আর রাতে মাছ রান্না করেছিল হোমস্টেতে। তারসাথে ভাত-ডাল-পাঁপড়-আচার আর আলুর একটা পদ। আজ রাতে রুটিও ছিল। আরো একটা রাত কেটে যায় কিগওয়েমার হোমস্টেতে। 

২ রা জুন, শুক্রবার সকালটা একটু ঘোরাঘুরি করলাম এদিক ওদিক তবে রাস্তার ওপর বলে বড্ডো ধূলো, বৃষ্টি হলে বা রাস্তা ভিজে থাকলে আলাদা নাহলে গাড়িগুলো যাচ্ছে আর একেবারে ধূলোয় স্নান করিয়ে দিচ্ছে একটু হাঁটাহাঁটি করতে বেরোলে। জলখাবারে পরোটা আর আলুর সব্জি। এরপর স্নান সেরে তৈরি হয়ে নিলাম। দুপুরের খাবার সেরে একইভাবে একইপথে ফিরে চলা। 

ফেরার সময়ও আমরা ১২ ঘন্টার জন্য রেলের রিটায়ারিং রুম বুক করে রেখেছিলাম ডিমাপুরে (২ রা জুন রাত ৮ টা থেকে ৩ রা জুন সকাল ৮ টা পর্যন্ত)। কারণ ফেরার ট্রেন মাঝরাতে ২-টো নাগাদ, অর্থাৎ ৩ রা জুন, শনিবার।

ওই একই ট্রেনে কামরূপ এক্সপ্রেসেই ফেরা।

কিভাবে যাবেন জুকু ভ্যালি

নাগাল্যান্ড যেতে হলে ইনার লাইন পারমিট (ILP) লাগে। এই পারমিট অনলাইনেই করে নেওয়া যায়। নাগাল্যান্ড ILP সার্চ করে, ফর্ম ভর্তি করুন। ফোন নং, ছবিসচিত্র পরিচয় পত্র সবই সাবমিট করতে হবে এই ফর্মে। এই পদ্ধতি সফল হলে কনফার্মেশন মেসেজ পাবেন। এর দু-তিনদিন পর পেমেন্ট অপশন পাবেন। জনপ্রতি ৫০ টাকা পেমেন্ট করলেই IPL পেয়ে যাবেন। এরপর প্রিন্ট করিয়ে নিন।

ট্রেন বা প্লেনে ডিমাপুর পৌঁছে অথবা সরাসরি ট্রেনের অভাবে গৌহাটি পৌঁছে, নাগাল্যান্ডের রাজধানী কোহিমা হয়ে পৌঁছনো যায় জুকু ভ্যালি। 

আমরা কামরূপ এক্সপ্রেসে যাওয়া-আসা করেছিলাম।

ডিমাপুর থেকে কোহিমা ৭৪ কিমি। কোহিমা থেকে কিগওয়েমা ১০ কিমি।  কিগওয়েমা থেকে জাখামা হয়ে বিস্বেমা আরো ৮ কিমি। পথেই জাখামা পরবে। জাখামা জুকু যাওয়ার অন্যতম প্রবেশদ্বার। এই পথ খাঁড়াই বেশি, জঙ্গল বেশি আর পথ হারানোর ভয় আছে। তাই আরো এগিয়ে বিস্বেমা। বিস্বেমা গ্রাম থেকে ট্রেক শুরুর জায়গা আরো ৮ কিমি। এই রাস্তাটা বেশ খারাপ। বড়ো গাড়ি ছাড়া অন্য গাড়ি চলেনা। ফেরার সময়ও গাড়ি বলে রাখতে হবে। নাহলে এই ৮ কিমি হেঁটে মূল রাস্তায় ফিরতে হবে। ট্রেক স্টার্টিং-পয়েন্ট থেকে জুকু ভ্যালির ক্যাম্প-সাইট ৮ কিমি।

ডিমাপুর থেকে জুকু ভ্যালি যাওয়ার ট্রেক-স্টার্টিং-পয়েন্টের দূরত্ব ১০০ কিমি। পুরো গাড়ি ভাড়া করে এলে আর সকাল সকাল বেরোলে ডিমাপুর থেকে সরাসরি এসেও ওইদিনই জুকু ভ্যালি পৌঁছে যাওয়া যায়। 

কোহিমাতে থেকেও আসা যায়। কোহিমা থেকে জুকুর ট্রেক স্টার্টিং পয়েন্টের দূরত্ব ২৬ কিমি। তবে কোহিমাতে থাকার বাজেট হোটেল তেমন নেই , থাকা-খাওয়ার খরচ বেশি। 

তবে যেখান দিয়েই আসুন ট্রেক পয়েন্ট অবধি পৌঁছতে শেষ ৮ কিমি কেবলমাত্র বড়ো গাড়িই ভরসা। 

*ট্রেনে/প্লেনে যাতায়াতের খরচ বাদ দিলে ডিমাপুর থেকে ডিমাপুর ৫ দিনে আমাদের এই পথে জনপ্রতি খরচ হয়েছে ৬,৫০০ টাকা করে সবমিলিয়ে। 

*নাগাল্যান্ড ঘোরার সময় আমার মনে হয়েছে অন্যান্য রাজ্যের মতোই নাগাল্যান্ড ঘোরা নিরাপদ। 

*আমরা নিরামিষ খেয়েছিলাম, ডিমও খেয়েছিলাম। খাওয়া নিয়ে নাগাল্যান্ডে আমাদের কোনো সমস্যা হয়নি।

DZUKOU VALLEY NAGALAND


কখন যাবেন জুকু ভ্যালি (DZUKOU VALLEY NAGALAND)

সারা বছর যাওয়া যায়। জুলাই-আগস্ট পিক-সিজন, এইসময় ভালো বৃষ্টি হয়। তাই পুরোপুরি প্রস্তুত হয়ে যাওয়া উচিত। সেপ্টেম্বর, অক্টোবর, নভেম্বরেও বেশ ভালো লাগে। আমরা গিয়েছিলাম মে মাসের একদম শেষে। পুজোর সময় আর ডিসেম্বরে হর্নবিল ফেস্টিভ্যালের সময় খুব ভিড় হয় জুকুতে। ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে জুকুতে খুবই ঠান্ডা থাকে।

জুকু ভ্যালিতে কোথায় থাকবেন

গৌহাটি ও ডিমাপুরে রেলের রিটায়ারিং রুম বেশ ভালো। অনলাইনে ট্রেনের টিকিট কাটলে ওই টিকিটেই থাকে রেলের রিটায়ারিং রুম বুকিংয়ের সুবিধা।

ডিমাপুরে সরকারি ট্যুরিস্ট লজটি স্টেশনের কাছেই। ট্যুরিস্ট লজের ফোন নং:-

03862-237033

6909636762

ডিমাপুর থেকে কোহিমা হয়ে আমরা সরাসরি চলে গিয়েছিলাম কিগওয়েমার ডন হোমস্টেতে। পুরো রাস্তাই খুব ভালো। প্রায় ৮৪ কিমি,  পৌঁছতে সময় লাগে ২ ঘন্টা। তবে জ্যাম থাকলে , ব্রেক-জার্নি সব ধরলে আরো ১ ঘন্টা। 

ডন হোমস্টের ফোন নং

Akieno Yhoshu

+91 9856259469

+91 8837350125

Rovitono Yhoshu

+91 8575826863

জুকু ভ্যালিতে থাকার তিনটে অপশন। টেন্ট, ডর্মিটরি আর কটেজ। সবই স্পট বুকিং হয়।

তবে যেখানেই থাকুন বিছানা-লেপ-কম্বল কোনোটাই খুব একটা পরিস্কার নয় জুকুতে।

Khuto Dzukou ph no

+91 8259918323

এই নম্বরে ফোন করলে কটেজ বুকিং হতে পারে। নম্বরটি জুকুর ক্যাম্পে কর্মরত একটি ছেলের। তবে এরা স্থায়ী কর্মচারী নয়। যদিও জুকুতে নেটওয়ার্ক নেই, পাহাড়ের মাথায় উঠলে নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়। সেক্ষেত্রে whatsapp বা মেসেজ করে রাখা যেতে পারে এডভান্স কটেজ বুকিংয়ের জন্য।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন