বর্ষায় বেড়ানোর অন্যতম সেরা ঠিকানা অযোধ্যা পাহাড়
বর্ষার পুরুলিয়া দেখার ইচ্ছে অনেকদিনের, তাই হঠাৎ করেই ঠিক হলো পুরুলিয়া যাবো। জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহ। পুরুলিয়া যাওয়ার এমনিতে বেশ কটা ট্রেন আছে রূপসী বাংলা, আরণ্যক তবে আদ্রা-চক্রধরপুর রাতের ট্রেন। রাত ১২-০৫ এ হাওড়া থেকে ছেড়ে ভোর ৬-২০ তে পুরুলিয়া পৌঁছনোর নির্ধারিত সময়। অর্থাৎ শুক্রবার রাতে ট্রেনে চাপলে তারিখ কিন্তু শনিবারের হবে, কারণ ১২ টার পর ট্রেনটি ছাড়ছে। শুক্রবার রাতে ট্রেনে চাপলে শনি-রবি ছুটির দিনের সাথে সোমবার আর একটা দিন যোগ করলেই খুব ভালোভাবে ঘুরে আসা যায় অযোধ্যা পাহাড় থেকে। সোমবার ছুটি না নিলেও একটু ঝটিতি সফর হবে। আমাদের সোমবার বিকেলে রূপসী বাংলাতে ফেরার টিকিট কাটা ছিলো। কিন্তু বিশেষ কারণবশতঃ রবিবার রাতেই আদ্রা-চক্রধরপুর ধরে ফিরতে হয়েছিল।
পুরুলিয়া স্টেশন থেকে দু'ঘন্টার পথ অযোধ্যা পাহাড়
শনিবার সকালে পনেরো মিনিট দেরীতে ট্রেন ঢুকল পুরুলিয়া স্টেশন। অযোধ্যা পাহাড়ের কাছের স্টেশন পুরুলিয়া। আমরা আর একটুও অপেক্ষা না করে স্টেশন থেকে বেরিয়ে একটা টোটো নিয়ে SBSTC বাসস্ট্যান্ড পৌঁছই, যাতে সকাল ৭ টার বাসটা ধরতে পারি। গিয়ে শুনলাম এখন SBSTC-এর বাস যাওয়া বন্ধ আছে। ওখানেই বেসরকারী বাসস্ট্যান্ড। অযোধ্যা পাহাড়ের উদ্দেশ্যে বাস ছাড়বে ৭-২৫ নাগাদ। টিকিটের ভাড়া জনপ্রতি ৪৫ টাকা করে। সময় লাগে দু-ঘন্টা। বাসে উঠে বসি। নির্ধারিত সময়ে বাস রওয়ানা হয় অযোধ্যা পাহাড়ের উদ্দেশ্যে। এত ভালো রাস্তা, ঠিক দু-ঘন্টার মধ্যেই পৌঁছে গেলাম অযোধ্যা পাহাড়। উপরি পাওনা সবুজে ছাওয়া প্রকৃতি, মাঝে মাঝে বৃষ্টি মাঝে মধ্যে রোদ্দুরের খেলা।
WBCADC লজ
বাস কন্ডাক্টরকে বলে রাখি নীহারিকার সামনে নামিয়ে দিতে যা WBCADC লজ বলেই বেশি পরিচিত। বাস রাস্তার ওপরই এই লজটি। অনেকটা জায়গা নিয়ে বেশ সুন্দর করে সাজানো। হোটেলে চেক-ইন করে সময় দেখলাম ৯-৩০। সারাটা দিনই আমাদের হাতে। একটু এগিয়ে একটা মিষ্টির দোকান থেকে কচুরী-চা খেয়ে জায়গাটা একটু ঘুরে দেখছি। একজন হাসি মুখে এসে বললেন গাড়ি লাগবে কিনা, ওনার নাম নকুল। আমরা ঠিক করলাম সারাদিন যখন সময় আছে স্নান-খাওয়া সেরে ঘুরে আসবো মুরগুমা বাঁধ থেকে, সঙ্গে সুইসাইড পয়েন্ট আর ফিরতি পথে ময়ূর পাহাড় ও দেখে নেবো। নীহারিকার খাওয়া-দাওয়া যথেষ্ট ভালো লাগলো আমাদের।
বৃষ্টিভেজা প্রকৃতিকে সঙ্গী করে মুরগুমার পথে
দুপুর দু'টো নাগাদ বেরিয়ে পড়লাম বলরামের সাথে। নকুল নিজে আসেনি বলরামকে পাঠিয়েছে।
দুদিকে ঘন সবুজে ছাওয়া রাস্তা, দূরে টিলা টিলা সবুজ পাহাড়। মেঘলা আবহাওয়া বলে গরমের লেশ মাত্র নেই। বৃষ্টি ভেজা প্রকৃতির ঠান্ডা-হাওয়ার ঝাপটা খেতে খেতে পৌঁছে গেলাম মুরগুমা। অযোধ্যা পাহাড় থেকে মুরগুমার দূরত্ব প্রায় ১৮ কিমি। সবুজ সবুজ টিলার ঘেরাটোপে অনেকটা জায়গা জুড়ে এক জলাধার। তবে শীতকালে পাহাড়গুলো রুক্ষ রূপ ধারণ করে তখন অন্যরকম সৌন্দর্য্য। আর জলাধারে এত জলও থাকেনা তখন। মুরগুমাতে থাকতে চাইলেও থাকার জায়গা আছে, বন-পলাশী ইকো রিসর্ট। এছাড়া গ্রামের মধ্যেও কয়েকটি হোটেল-হোমস্টে হয়েছে। শুনেছি দিনের বিভিন্ন সময় এই জলাধারের রঙ পরিবর্তন হয়। আমরা এটা মুকুটমনিপুরে দেখেছিলাম। সূর্যের অবস্থানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে জলাধারের রঙ পরিবর্তন। সূর্যাস্তের সময়টাও দারুণ লাগে, বাঁধের জলে চলে রঙের খেলা যেমনটা দেখেছিলাম বড়ন্তিতে। এখন তো মেঘলা তাই অন্যরকম রূপ। যদিও সেসব দেখতে হলে একটা রাত কাটাতে হবে এখানে। সুইসাইড পয়েন্ট থেকে পুরো মুরগুমা জলাধার একনজরে দেখা যায়। ময়ূর পাহাড় থেকেও শুধু সবুজের সমারোহ চারদিকে এই বর্ষার সময়টা। এখান থেকেও সূর্যাস্ত সুন্দর দৃশ্যমান। ময়ূর পাহাড় যাওয়া-আসার পথেই সীতাকুন্ড। কিংবদন্তি অনুসারে বনবাসকালে এখানে এসে সীতা তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়লে রাম নিজের তীরের সাহায্যে মাটি খুঁড়ে জল বের করে আনেন। তাই জায়গাটি সীতাকুন্ড নামে পরিচিত।
আর কি চাই!
হোটেলে ফিরে সন্ধ্যায় কফি আর পকোড়া তার সাথে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। রাতে রুটি, পনির, তর্কা আর পোস্তর বড়া। তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লাম কারণ আগামীকাল সারাদিন ঘোরা তারপর বাস ধরে পুরুলিয়া স্টেশন পৌঁছে ফেরার ট্রেন ধরতে হবে। বেশ ছুটোছুটি হবে আর মনটাও খারাপ। কাজ না পরে গেলে আগামীকালও থাকতে পারতাম ভেবে।
ঘরে তিনটে পাখা। রাতে বেশ শীত শীত করছিল। আমাদের ঘর ভাড়া ১০০০ টাকার মধ্যে। এসি ঘরও আছে এখানে। সকাল সকাল লুচি তরকারি জলখাবার সেরে বেরিয়ে পড়লাম। ৯ টা নাগাদ হোটেলের সামনেই বলরাম এসে হাজির গতকালের গাড়ি নিয়ে। ছোট গাড়ি, চারজন বসার মতো। গতকাল আর আজকের ঘোরাঘুরি নিয়ে মোট ৩,৫০০ টাকায় চুক্তি হয়েছিল (সময়টা ২০২২ সালের জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহ)।
অযোধ্যা পাহাড়কে ঘিরে আশে পাশে ঘোরার জায়গা
প্রথমেই গেলাম মার্বেল লেক। পাথরে ঘেরা স্বচ্ছ টলটলে জলাশয়। এটি আসলে পরিত্যক্ত খাদান।
একটু এগিয়েই বামনী জলপ্রপাত। জলপ্রপাতটি বর্ষাকালে দেখতে অপূর্ব লাগে। সম্পূর্ণরূপে এটি দেখতে ও উপভোগ করতে হলে পাথুরে সিঁড়ি দিয়ে অনেকটা নীচে নেমে যেতে হবে। বামনী জলপ্রপাত দেখতে বেশ খানিকক্ষণ সময় লাগল।
এরপর গেলাম তুর্গা জলপ্রপাত। দুটি জলপ্রপাতই খুব সুন্দর। পথেই খেঁজুর পাতা দিয়ে বানিয়ে খুব সুন্দর ফুল বিক্রি করছিল বাচ্চারা-- একটা নিলাম।সবুজে ঘেরা তুর্গা লেক। এখানে দেখলাম থাকারও হোটেল আছে।
তুর্গা লেক দেখে প্রায় ১০ কিমি দূরে চড়িদা গ্রাম। বাঘমুন্ডির চড়িদা গ্রাম ঘুরে বেশ কিছু মুখোশ সংগ্রহ করলাম। মুখোশগুলি খুবই সুন্দর আর কাগজের তৈরি বলে হালকাও। উপহার দেওয়ার জন্য বা ঘর সাজানোর জন্য চমৎকার। আর দামও বেশি নয়।
কাছেই খয়রাবেড়া বাঁধ। সবুজ সবুজ টিলায় ঘেরা অনেকটা জায়গা জুড়ে বিস্তৃত জলাশয়। বর্ষাকালে খয়রাবেড়ার এমন শ্যামলিমায় মুগ্ধ হয়ে গেলাম। মেঘলা আকাশের সামিয়ানার নীচে ঘন সবুজের ঘেরাটোপে এই জলাধার যেন আরো মোহময়ী হয়ে উঠেছে। বাঁধের রাস্তা ধরে হেঁটে বেশ অনেকটা সময় এখানেই কাটিয়ে দেওয়া যায়। থাকারও জায়গা আছে, খয়রাবেড়া ইকো অ্যাডভেঞ্চার ক্যাম্প। তবে থাকার জন্য জায়গাটা বড্ডই নির্জন। হঠাৎই ঝেঁপে বৃষ্টি এসে যাওয়ায় ছুটে গিয়ে গাড়িতে উঠে পড়তে বাধ্য হলাম। গাড়ি ছুটে চলল আবার আদিবাসী গ্রাম, চাষের খেতের পাশ দিয়ে, কোথাও একপাল ভেড়া চড়ে বেড়াচ্ছে।
পাখি পাহাড়
ছুটে চলেছি পাখি পাহাড়ের পথে। দুপুরের খাবার সারলাম সোনকুপি ক্যাফে'তে। পরপর শাল, সেগুন, শিরীষ, মহুয়া, অর্জুন গাছে ছাওয়া বনভূমির পথ পেরিয়ে ছুটে চললাম। পথে নজর কাড়ল পদ্ম-পুকুর। দূর থেকেই চোখে পড়ল পাখির ছবি খোদাই করা পাখি পাহাড়। ওদিকে এগিয়ে যেতেই দেখলাম "কর্ণসুবর্ণের গুপ্তধন" শ্যুটিং স্পট। শ্যুটিংয়ের জন্য সাজানো জায়গাটা এখনও ওরকমই সাজানো আছে।
অযোধ্যা পাহাড়ের দর্শনীয় স্থান |
ফিরতি পথে
পাখি পাহাড় ঘুরে ছুটে চলি অযোধ্যা পাহাড়ের দিকে। পথে লহরিয়া শিব মন্দির; এখন শ্রাবণ মাস বলে অসম্ভব ভিড়। সারাক্ষণই ভক্ত-তীর্থযাত্রীদের সমাগম। আমাদের তারকেশ্বরের মতোই।
অযোধ্যা পাহাড়ের উপর কংসাবতী নদীতে দুটি ড্যাম রয়েছে। এদের একটি হল লোয়ার ড্যাম। সূর্যাস্তের জন্য এই জায়গা খুবই মনোরম। লোয়ার ড্যাম থেকে পাহাড় ধরে উপরে উঠে গেলেই আপার ড্যাম। এখানে জল সঞ্চয় করে রাখা হয় বিদ্যুৎ তৈরির জন্য আর জল পৌঁছয় লোয়ার ড্যামে। আপার ড্যাম থেকে পুরো অযোধ্যা পাহাড় দেখা যায়। লোয়ার ড্যাম, আপার ড্যাম হয়ে নীহারিকার সামনে। এখানেই আমাদের এবারের মতো পুরুলিয়া দর্শন সমাপ্তি করতে হয়। নীহারিকা থেকে একটু এগিয়ে গিয়ে যুব আবাসের সামনেই বাসস্ট্যান্ড। বাসস্ট্যান্ড থেকে বাসে ওঠাই ভালো, না হলে ভিড় হয়ে যায়। ফিরে চলি পুরুলিয়া স্টেশন।
কিভাবে যাবেন অযোধ্যা পাহাড়
পুরুলিয়া যাওয়ার সব থেকে ভালো উপায় রাতের হাওড়া-চক্রধরপুর প্যাসেঞ্জার ট্রেন। ট্রেনটি হাওড়া থেকে ছাড়ে রাত ১২-০৫ এ। টিকিট কাটার সময় খেয়াল রাখবেন, যদি শুক্রবার রাতের টিকিট কাটেন তারিখ হবে শনিবারের কারণ রাত ১২- টা পেরিয়ে ট্রেনটি ছাড়ে। পুরুলিয়া পৌঁছয় সকাল ৬-৩০ টায়। এছাড়াও সকালের ট্রেন রূপসী বাংলা, আরণ্যক আছে। এসপ্লানেড থেকে বাসেও পুরুলিয়া পৌঁছনো যায়। পুরুলিয়া বাসস্ট্যান্ড থেকে অযোধ্যা পাহাড় প্রায় ৪০ কিমি। বাস অথবা গাড়িভাড়া করে অযোধ্যা পাহাড় পৌঁছতে দু'ঘন্টা লাগে।
অযোধ্যা পাহাড়ে দু'দিন থেকে ঘুরে নেওয়া যায় এই জায়গাগুলি:- মুরগুমা বাঁধ, মার্বেল লেক, বামনী জলপ্রপাত, তুর্গা জলপ্রপাত, তুর্গা জলাশয়, চড়িদা মুখোশ গ্রাম, খয়রাবেড়া বাঁধ, লহরিয়া শিব মন্দির, লোয়ার ড্যাম, আপার ড্যাম, ময়ূর পাহাড়, সীতাকুন্ড।
পুরুলিয়া
থেকে অযোধ্যা পাহাড় কত কিলোমিটার |
কখন যাবেন অযোধ্যা পাহাড় পুরুলিয়ায়
খুব গরমের সময় বাদে সারা বছর যাওয়া যায়। শীতকালে লেক, জলপ্রপাতে জল কম থাকে। বর্ষায় গেলে অন্যরকম রূপ। সবুজে ছাওয়া প্রকৃতির স্নিগ্ধ রূপ ধরা দেয় এইসময়। বসন্তে একটু গরম হলেও শিমূল, পলাশ, কুসুমে লাল হয়ে থাকে পুরুলিয়া।
কোথায় থাকবেন অযোধ্যায় বেড়াতে গিয়ে
WBCADC লজ নীহারিকা, মালবিকা, বলাকা ইত্যাদি। (WestBengal Comprehensive Area Development Corporation)
ফোন নম্বর:-
O33-2237704143
8001934058
7501524345
অযোধ্যা পাহাড় ইয়ুথ হোস্টেল অর্থাৎ যুব আবাস
এখানে থাকার জন্য অনলাইনে বুকিং করতে হয়। অফলাইন বুকিংয়ের কোনো উপায় এখানে নেই।
যুব আবাস বুকিংয়ের লিংক:-
অযোধ্যা পাহাড় চূড়ায় আকাশ হিলটপ রিসর্ট ,কুশল পল্লী রিসর্ট ছাড়াও আরো অনেক সাধারণমানের থেকে শুরু করে বিলাসবহুল হোটেল রিসর্ট । যেমন:-
- শ্রী দুর্গা লজ 9785363833/ 9933907348
- পারিবারিক লজ 8159850044
- কঙ্কা ট্যুরিস্ট লজ 9732134656
- রেণুকা লজ 9647595073/ 9732089041
অযোধ্যা মোড়ে এই চারটি সাধারণমানের হোটেলসমেত আরো কিছু হোটেল আছে।
আর আছে ভারত সেবাশ্রম সংঘ। ফোন নং:- 9434877570/ 03252-202894
গাড়ির জন্য নকুলের ফোন নং:- 7477333401