জয়চন্ডী পাহাড়, পুরুলিয়া | Joychandi hills Puruliya Tour Plan

আদ্রা জংশন স্টেশন থেকে জয়চন্ডী পাহাড়

গতবছর বর্ষাকালে অযোধ্যা পাহাড় গিয়ে আমি পুরুলিয়ার প্রেমে পড়ে গেছি! তাই এবারও একই সময়, একইভাবে পুরুলিয়ায় পৌঁছে গেলাম। সেই রাতের হাওড়া-চক্রধরপুর ধরে। তবে এবার পুরুলিয়া স্টেশন অবধি না গিয়ে একঘন্টা আগেই আদ্রা জংশনে নামলাম একদম ভোরবেলা। এরপর টোটো নিয়ে ১৫-২০ মিনিটের মধ্যে জয়চন্ডী পাহাড়ের যুব আবাস। আদ্রা থেকে লোকাল ট্রেনে জয়চন্ডী পাহাড় স্টেশন ১.৫ কিমি। জয়চন্ডী পাহাড়ের একদম গা-ঘেঁষে অসাধারণ অবস্থান যুব আবাসটির অনেকটা জায়গা জুড়ে তৈরি।

Joychandi hills puruliya

এলাকা জুড়ে বড়ো বড়ো পাথরের ভূ-দৃশ্য

সত্যজিৎ রায়ের 'হীরক রাজার দেশে'র শ্যুটিং স্পট এই জয়চন্ডী পাহাড়। উনি গুণী মানুষ ছিলেন, দূরদর্শী ছিলেন আর ওনার দেখার চোখ ছিল আলাদাই। তাই এমন একটা জায়গা খুঁজে বের করেছিলেন। পুরুলিয়ার অন্যতম সুন্দর এই স্থান। চারটি ন্যাড়া পাহাড়ের সমাবেশ এই অঞ্চলে। এছাড়াও ছোট ছোট টিলা আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। যাদের স্থানীয় নাম রামসীতা পাহাড়, লক্ষ্মণ পাহাড়, কালী পাহাড়, সিজানো, যোগিয়ার ঢাল আরো কত কী! পুরো এলাকা জুড়েই রয়েছে বড়ো বড়ো পাথরের বোল্ডার। 

জয়চন্ডী পাহাড় যুব আবাস বা ইয়ুথ হোস্টেল

যুব আবাসের অবস্থান এত সুন্দর জায়গায় যে এখানেই অনেকটা সময় কাটিয়ে দেওয়া যায়। একদম নির্জন, নিরিবিলি, সামনেই মন্দির, প্রচুর গাছপালা পাখিতে ভর্তি। দুটো পাহাড়ের মাঝখানে এর অবস্থান। এখানে খাবার ব্যবস্থা বলতে অনেকটা হোম-সার্ভিস যেমন হয় তেমন। বলে দিলে খাবার দিয়ে যাবে। যুব আবাসে রান্না হয় না। তবে রান্নাঘর আছে। হয়ত আগে ব্যবস্থা ছিল এখন আর নেই। তাই চা পাওয়াটা একটু অসুবিধা। শুধু চা তো আর আনতে বলা যায় না। কিছুটা এগিয়ে হিল-রিসর্টে বা আরো এগিয়ে জয়চন্ডী পাহাড়ে ওঠার নীচে দোকানগুলো যেতে হবে চায়ের জন্য প্রায় দশ-পনেরো মিনিট হাঁটা পথ। অনেক লোকজন একসাথে থাকলে সকালে হয়ত এনে দেয়। জুলাইয়ের চতুর্থ সপ্তাহে  আমরা তিনজনই আছি পুরো যুব আবাসে দুদিন। ২১ শে জুলাই রাতের ট্রেন ধরে ২২ শে ও ২৩ শে জুলাই জয়চন্ডী পাহাড়ের যুব আবাসে কাটিয়ে ২৪ শে জুলাই বেলা ১০-০৫ এ রাঁচি-হাওড়া ইন্টারসিটি ধরে বিকেল ৩-১৫ এ হাওড়া। আগের দিন অর্থাৎ ২৩ শে জুলাই রাতের চক্রধরপুর-হাওড়া ধরেও ফেরা যায়। এই সময়টা এখন এখানে অফ-সিজন। যা ভিড় হবে ১৫ ই আগস্টের সময়টা তারপর আবার পুজো থেকে টানা পলাশের সময় প্রায় এপ্রিল অবধি। 

যুব আবাসে কিন্তু লিফটের কোন ব্যবস্থা নেই। আর গ্রাউন্ড ফ্লোরে অর্থাৎ নীচের তলায় কোন ঘর নেই। ঘর শুরু একতলা থেকে দোতলা, তিনতলা অবধি। তাই সঙ্গে বয়স্ক মানুষ থাকলে যদি সিঁড়ি ভাঙতে অসুবিধা হয় তাহলে সমস্যা। একতলা অবধিও উঠতে পারলে ফোনে কথা বলে সেইমতো ঘর বুক করা যেতে পারে বড়োজোর। এখানে সব স্টাফেরাই খুব ভালো হেল্পফুল। আমরা আছি একতলায় ১১৩ নং ঘরে। ঘরটি তিনশয্যাবিশিষ্ট, নন-এসি। এখানে তিনশয্যাবিশিষ্ট এসি ঘর নেই।  দ্বিশয্যাবিশিষ্ট, চারশয্যাবিশিষ্ট ঘর এসি/নন-এসি দুরকমই আছে।

একতলায়, দোতলায়, তিনতলায় একটি করে ঘরের সাথে আছে লাগোয়া নিজস্ব বারান্দা, বেশ বড়ো বারান্দা। এগুলো বোধহয় ভিভিআইপি রুম হবে। 

যুব আবাসের তিনতলায় রয়েছে চারটি দোলনা যা সবাই ব্যবহার করতে পারে। আর ছাদ থেকেও চারপাশের দৃশ্য খুব সুন্দর। ছাদে পরপর বসানো রয়েছে সোলার প্যানেল। 

Joychandi hills Puruliya Tour Plan

জয়চন্ডী পাহাড়কে ঘিরে ড্যাম মন্দির

জয়চন্ডী পাহাড়ে থেকে বড়ন্তি, গড়পঞ্চকোট, পাঞ্চেৎ ড্যাম, মাইথন, কল্যাণেশ্বরী মন্দির ঘুরে নেওয়া যায়। এসব জায়গাগুলো আগেই আমাদের ঘোরা বলে এবার আমরা বিশেষ ঘোরাঘুরি করিনি। শুধু জয়চন্ডী পাহাড়ের পথে পথে ঘুরে, সকাল-বিকেল পাহাড়ের মাথায় গিয়ে বসে থেকে কেটে গেল দুটোদিন।

গ্রাম্য পরিবেশ

বর্ষার এই সময়টা রোদ্দুর উঠলে গরম একটু লাগে ঠিকই কিন্তু মেঘলা করে গেলে আরাম আর ফাঁকা জায়গা বলে সবসময় একটা হাওয়া চলতে থাকে এখানে তাই বিশেষ কষ্ট হয় না।চারপাশে অনেক পুকুর তাতে কোথাও কোথাও পদ্মফুল ফুটে আছে আর এই বর্ষায় চারপাশটা সবুজ হয়ে ওঠে। একেবারেই গ্রাম্য পরিবেশ।

"হীরক রাজার দেশে" শ্যুটিং স্পট

মন্দিরে ওঠার আগে একটা বড়ো মাঠ আছে এখানে 'হীরক রাজার দেশে'র সেই বিখ্যাত "দড়ি ধরে মারো টান রাজা হবে খান খান" দৃশ্যের শ্যুটিং হয়েছিল। উদয়ন পণ্ডিত যেই পাহাড়ের গুহায় লুকিয়ে ছিলেন তা এই জয়চন্ডী পাহাড়। মনে পড়ে দৃশ্যগুলো! প্রতি বছর ডিসেম্বরের শেষে জয়চন্ডী পাহাড় মেলা হয় এখানে।

পাহাড়ের মাথায় জয়চন্ডী মায়ের মন্দির ও সীতাকুন্ড

মন্দিরে ওঠার সিঁড়িগুলো একদম ছোট ছোট ধাপ। মোট ৪৭৫ টা মত সিঁড়ি আছে, মাঝে বসার জায়গাও আছে।

পাহাড়ের মাথায় সংকটমোচন মন্দির আর জয়চন্ডী মায়ের মন্দির আছে। পাহাড়ের ওপর থেকে চারপাশের দৃশ্য খুবই সুন্দর। সারাক্ষণ হু হু করে হাওয়া চলে। অনেকক্ষণ বসে  থেকেই কেটে যায়। মন্দিরের পেছন দিকে একটু নেমে জলের ছোট একটি কুন্ড আছে যা সীতাকুন্ড। এই সীতাকুন্ডকে ঘিরে আছে পৌরাণিক কাহিনী। বর্ষাকালের বিকেলের আকাশ এমনিতেই সুন্দর থাকে। পাহাড়ের ওপর থেকে সূর্যাস্ত দেখতে অসাধারণ লাগে, বিশেষ করে এই সীতাকুণ্ডের দিকটা থেকে। সূর্যাস্ত হয়ে গেলে পাহাড় থেকে নেমে এক কাপ চা খেয়ে যুব আবাসের পথ ধরি। সন্ধ্যের পর আর পাহাড়ে উঠতে দেওয়া হয় না।

জয়চন্ডী পাহাড়ে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা

মন্দিরে যাওয়ার পথেই পড়বে জয়চন্ডী হিল রিসর্ট। জয়চন্ডী হিল রিসর্টের মধ্যে ছোটদের জন্য একটি পার্ক আছে। এখানে ১০ টাকা দিয়ে টিকিট কেটে ঢোকা যায়। পার্কের বাইরে রেস্টুরেন্টে খাওয়া-দাওয়ার ও ব্যবস্থা আছে। এইসময় যুব আবাসে শুধু আমরাই আছি। হিল-রিসর্টে কিন্তু লোকজন আছে। আবার অনেকে গাড়ি নিয়ে এসেছে, খাওয়া-দাওয়া করে ফিরেও যাচ্ছে। এর অন্যতম কারণ বোধহয় যুব আবাসে রান্নার ব্যবস্থা নেই বলে। বাইরে হোটেলে বলে দিলে খাবার এনে পরিবেশন করে খাইয়ে দিয়ে যায়। ডাইনিংটাও বেশ বড়ো, চেয়ার টেবিল সবই আছে। মাছ-ভাত-ডাল-সব্জী-ভাজা ১২০ টাকা করে। চিকেন নিলে ১৮০ টাকা। ডিম-টোস্ট জলখাবারে ৫০ টাকা প্লেট। যে ছেলেটি দুদিন ধরে আমাদের খাবার এনে দিচ্ছে ওর নাম সৌমেন। জয়চন্ডী পাহাড়ে ওঠার মুখে সিঁড়ির কাছে ওদের হোটেল আছে। রান্না খুবই ভালো। ওরাই এখানে খাবারের ব্যবস্থা করে। একসঙ্গে বড়ো দল থাকলে যুব আবাসে নিজেরাও রান্নাবান্না করে খাওয়া যায়। যুব আবাসে অ্যাকোয়া গার্ড আছে তাই জল নিয়ে কোন সমস্যা নেই।

আমরা জয়চন্ডী পাহাড় থেকে নেমে ফেরার সময় সন্ধ্যায় চা/কফি স্ন্যাকস ওই হিল রিসর্ট থেকে খেয়ে ফিরছি যুব আবাসে। তবে সন্ধ্যার পর হিল রিসর্ট থেকে যুব আবাসে আসার রাস্তাটা বেশ অন্ধকার হয়ে যায়। দশ-মিনিটের রাস্তা। এরপর যুব-আবাসের রাস্তায় আলোর ব্যবস্থা আছে। এই রাস্তাটা বেশ নির্জনও। রাতের খাবার নিয়ে আসে ৯-৩০ টা নাগাদ। ভাত/রুটি চিকেন যা বলা হয় সবই নিয়ে এসে খাইয়ে যায় সকালের মতোই।

চেলিয়ামা পুরনো রাধা-গোবিন্দ মন্দির

আমরা একবেলা একটা টোটো নিয়ে চেলিয়ামার দিকটা গিয়েছিলাম। চেলিয়ামার পুরনো রাধা-গোবিন্দ মন্দিরে টেরাকোটার কাজ আছে যার বেশিরভাগ নষ্টই হয়ে গেছে। আর কাছেই বান্দার দেউল। বান্দার-দেউল বসন্তে বেশি ভালো লাগে। ওইসময় এখানে পলাশফুলে ভর্তি থাকে। রঘুনাথপুর ব্লক-১ এ জয়চন্ডী পাহাড় আর রঘুনাথপুর ব্লক-২ এ চেলিয়ামা। জয়চন্ডী পাহাড় থেকে চেলিয়ামা প্রায় ১৫ কিমি। চেলিয়ামা থেকে তেলকূপী আরো ৭-৮ কিমি। তবে তেলকূপীতে এখন কিছুই নেই। একসময় অনেকগুলি মন্দির ছিল এই অঞ্চলে। সেসব মন্দিরগুলি ধীরে ধীরে দামোদরের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। শুধু ইতিহাসের সাক্ষীস্বরূপ কতগুলো পাথর মাথা উঁচু করে নিজেদের অতীত গর্ব টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করে চলেছে। জানিনা এইভাবে আর কতদিন টিকে থাকবে।

কখন যাবেন

খুব গরমের সময় বাদ দিয়ে বছরের যেকোন সময় যাওয়া যায়। শীতকাল ভ্রমণের উপযুক্ত সময়। তখন আবহাওয়া আরামদায়ক থাকে। পাতাঝরার এইসময়টা রুক্ষ পাথুরে সৌন্দর্য্য ধরা দেয়। বসন্তে গাছে গাছে নতুন পাতা আর ফুলে ভরে যায়। পুরুলিয়া সেজে ওঠে শিমূল পলাশ কুসুমের লাল আগুন রঙে, সময় আসে গরমেরও আগুন ছোটার। 

বর্ষাকালে গরম থাকলেও মেঘলা হলে আবহাওয়া মনোরম থাকে। মাঝে মাঝে বৃষ্টি আর রোদ্দুরের খেলা চলতে থাকে। ফাঁকা জায়গা বলে প্রচুর হাওয়া খেলে। একটানা রোদ্দুর উঠলে কষ্ট হয়। আবার একটানা বৃষ্টি হলেও অসুবিধা, সেটা হয় সাধারণত নিম্নচাপ হলে। না হলে মাঝে মাঝে বৃষ্টি, রোদ্দুর, মেঘলা দারুণ লাগে এইসময়। বর্ষায় সবুজের সমারোহ দেখার মতো। পুকুর, নদী, জলাশয়গুলি জলে ভরে থাকে।

Joychandi Youth Hostel

কোথায় থাকবেন

জয়চন্ডী পাহাড়ে থাকার তিনটি জায়গা। ( ১) জয়চন্ডী হিল রিসর্ট, (২) পথসাথী, পথসাথী আগে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ছিল এখন বেসরকারি হয়ে গেছে। (৩) যুব আবাস বা ইয়ুথ হোস্টেল। যুব আবাস বুকিং শুধুমাত্র অনলাইনেই হয়। যুব আবাস বুকিংয়ের লিংক :  youthhostelbooking.wb.gov.in

জয়চন্ডী পাহাড় যুব আবাসের ফোন নং:- 06292248871

এখানে একশয্যাবিশিষ্ট/সিঙ্গল থেকে ভিভিআইপি সব ধরণের ঘর আছে।

দ্বিশয্যাবিশিষ্ট এসি ঘর ৮০০ টাকা (double bed AC room Rs/800)। 

তিনশয্যাবিশিষ্ট নন-এসি ঘর ৭৫০ টাকা (triple bed room non-AC room Rs/ 750)।

চারশয্যাবিশিষ্ট এসি ঘর ১২৫০ টাকা ( four bed AC room Rs/ 1250)। এরকম বিভিন্ন মানের ও দামের সবরকম সুবিধাযুক্ত ঘর আছে।

কিভাবে যাবেন

 সকালের রূপসী বাংলা, আরণ্যক, হাওড়া-রাঁচি ইন্টারসিটি এক্সপ্রেস এরকম বেশ কিছু ট্রেন আছে যেগুলি আদ্রা জংশন যায়। তবে সবচেয়ে ভালো রাতের আদ্রা-চক্রধরপুর প্যাসেঞ্জার ট্রেন। প্রতিদিন রাত ১২-০৫ এ হাওড়া ছেড়ে ভোর ৫-২০ তে আদ্রা পৌঁছয়। আদ্রা স্টেশন থেকে বেরিয়ে টোটো করে যুব-আবাস পৌঁছতে ১৫/২০ মিনিট সময় লাগে। ভাড়া ১৫০ টাকা। আদ্রা থেকে লোকাল ট্রেনে জয়চন্ডী পাহাড় স্টেশনেও যাওয়া যায়। সেখান থেকেও টোটো/রিক্সা করে বা হেঁটে যুব আবাস পৌঁছতে হবে দূরত্ব ২-৩ কিমি। 

আদ্রা বা জয়চন্ডী পাহাড় স্টেশনের দিক থেকে এলে প্রথমে পরবে হিল রিসর্ট, এরপর পথসাথী, এরপর যুব আবাস। হিল রিসর্ট থেকে সোজা পথ গেছে পাহাড়ে ওঠার সিঁড়ির দিকে আর একটা পথ পথসাথী হয়ে যুব আবাসের দিকে। যুব আবাস থেকে পাহাড়ে ওঠার সিঁড়ি অবধি হেঁটে যেতে ১০-১৫ মিনিট লাগে। আর সিঁড়ি দিয়ে পাহাড়ে উঠতে প্রায় ২০ মিনিট, খুব বেশি হলে আধঘন্টা।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন