মুকুটমণিপুর, বাঁকুড়া ভ্রমণ | Mukutmanipur Bankura Travel Guide

 প্রকৃতির মধ্যে ছোট্ট অবসর যাপনের জন্য মুকুটমণিপুর।

সেচের কাজে ব্যবহারের জন্য কুমারী আর কংসাবতীকে বাঁধা হয়েছে একই সুরে, নদী আর ছোট ছোট টিলার মেলবন্ধনে বাজে সেই অদ্ভুত রোমান্টিক সুর। ১১ কিমি দীর্ঘ এবং ৩৮ মিটার উঁচু বাঁধ দিয়ে বাঁধা দুই নদীর সঙ্গম মুকুটমণিপুর।

mukutmanipur

বনপুকুরিয়া-মৃগদাব 

হাওড়া থেকে রাত ১২-০৫ এর আদ্রা-চক্রধরপুর প্যাসেঞ্জার ট্রেন ভোর ৪-০৬ এ বাঁকুড়া স্টেশন পৌঁছয়। সেখান থেকে মাচানতলা বাসস্ট্যান্ড। এখান থেকে মুহুর্মুহু বাস ছাড়ছে খাতরা হয়ে মুকুটমণিপুর যাওয়ার। মাচানতলা থেকে মুকুটমণিপুরের দূরত্ব ৫৬ কিমি। পৌঁছতে সময় লাগে প্রায় ২ ঘন্টা।

বর্ষায় অযোধ্যা পাহাড়, পুরুলিয়া ভ্রমণ 

হোটেল আম্রপালিতে পছন্দমত ঘর ঠিক করে, রাত জার্নির ক্লান্তি ধুয়ে প্রাতঃরাশ সারতে কিছুটা সময় অতিবাহিত হল। আর দেরী না করে একটা ভ্যান-রিকসায় চেপে বসলাম, যাব বনপুকুরিয়া মৃগদাব অর্থাৎ ডিয়ার-পার্ক। আসল উদ্দেশ্য হল বাঁধের রাস্তা ধরে ঘোরা। বাঁধের জলে নৌকোবিহারের মাধ্যমেও পৌঁছনো যায় ডিয়ার-পার্কে। যেতে আসতে সব মিলিয়ে তিন-চারঘন্টা লাগে। সময়টা বর্ষাকাল তাই রোদ-বৃষ্টির লুকোচুরি খেলা চলতেই থাকে। ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে আর দু-পাশের নিসর্গ দেখতে দেখতে একটা টিলার সামনে দাঁড়ালাম। টিলাটির নাম লোহাপাহাড়। এখানকার পাথরে লোহা থাকে। আরো কিছুটা গিয়ে পরেশনাথ নামক পাহাড়ি টিলায় শিবলিঙ্গ, পার্শ্বনাথের মূর্তি অসংরক্ষিত অবস্থায় ছড়ানো এই টিলা থেকে চারপাশের দৃশ্য মনোমুগ্ধকর। 

কাছেই মুসফিরানা পার্ক। একটি টিলার ওপর সুন্দর সাজানো ভিউ-পয়েন্ট। এখান থেকে আরো একটু এগুলেই পৌঁছে যাই ফেরিঘাট। এখানেই কুমারী আর কংসাবতী নদীর সঙ্গম। একটা খাল কেটে দুটি নদীকে যুক্ত করা হয়েছে। দাঁড় টানা পানসি তরীতে চেপে ১০ মিনিটে পৌঁছে যাই ওপারে। এখান থেকে আরো দেড়-কিমি হাঁটাপথে যেতে হয় হরিণ দেখতে। দু-পাশে মহুয়া-পলাশে ছাওয়া, মাঝখান দিয়ে লাল মাটির কাঁকুড়ে পথ। মাঝেমধ্যেই নাকে আসে বুনো গন্ধের ঘ্রাণ। পৌঁছে যাই ডিয়ার-পার্কে।

 কিছুক্ষণ হরিণদের পাতা খাওয়ানোর খেলায় মেতে উঠি। পাতা খাওয়ার লোভে একসাথে অনেক হরিণ এসে জড়ো হয়েছিল। আমরা প্রায় ১২ টি হরিণ দেখতে পেয়েছি। তাদের মধ্যে দু-তিনজনের সুদৃশ্য বাঁকানো শিং। এতক্ষণ ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছিল, এবার ঝেঁপে নামল। বৃষ্টি আর থামছে না। বৃষ্টির মধ্যেই ফেরার পথ ধরলাম। কাঁকুড়ে রাস্তায় নিজেদের জুতোর মসমস শব্দ আর বৃষ্টির ঝমঝম শব্দ---- এছাড়া চারিদিক নিস্তব্ধ। 

এখান থেকে কিছুটা দূরে ২-৩ কিমি হবে প্রকৃতির মধ্যে সময় কাটানোর একটি সুন্দর জায়গা দোলাডাঙ্গা। অর্থাৎ বাঁধের একদিকে মুকুটমণিপুর অপরদিকে দোলাডাঙ্গা। বৃষ্টি থামার পর ধীরে ধীরে লোক জড়ো হলো। এরপর সাইকেল, বাইক প্রভৃতি নৌকোয় তুলতে কিছুক্ষণ সময় লাগলো। এটা অবশ্য ভটভটি নৌকো তাই তাড়াতাড়ি পৌঁছে গেলাম। ভ্যান-রিক্সার চালককে প্রায় দু-ঘন্টা এপারের ফেরিঘাটে বসে আমাদের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে। ভ্যানে চেপে আমরা এসেছি প্রায় ৭ কিমি পথ। এবার উল্টোদিকে ফেরার পথ ধরি। যাওয়ার সময় নদীর এক রং দেখেছিলাম আবার ফেরার সময় বদলে গিয়ে অন্য রং ধরেছে। ফিরতে বেশ বেলা হয়ে গেল। 


বাঁধের জল ছাড়ার দৃশ্য

দ্বিপ্রাহরিক আহার সেরে গেলাম বাঁধের কাছে জল ছাড়া দেখতে। এখন বর্ষাকাল তাই ১১ টি গেটের মধ্যে ৫ টি গেট খুলে দিয়ে অতিরিক্ত জল ছাড়া হচ্ছে। জলের আওয়াজ অনেক দূর থেকেও শোনা যাচ্ছে। বাঁধের উপর থেকে দেখা যায় ভীষণ রূপে আর ভীষণ গর্জনে জল আছড়ে পড়ার দৃশ্য। তবে এ দৃশ্য সবসময় দেখা যায় না। এখন বর্ষাকাল তাও শুনছি দু-একদিনের মধ্যে জল ছাড়া বন্ধ হয়ে যাবে। আমাদের ভাগ্য ভালো। দুর্দান্ত দামালবেগে পাথরের বুকে জল আছড়ে পড়ছে আর তার সঙ্গে পাথুরে নিসর্গ স্থানটিকে আলাদা রূপ দিয়েছে। ধোঁয়ার মত বাতাসে জলকণা উড়ছে। অনেকটা সময় কেটে গেল এই দৃশ্য দেখতে দেখতে। 


নদীর রং আর রূপ বদল

এবার গেলাম নদীর কাছে।  বাঁধানো বসার জায়গায় বসে জল দেখছি। দূরে দেখা যাচ্ছে পিয়ারলেসের লজ। সামনে নদীর ধারে শিকারা দাঁড়িয়ে। জোৎস্না রাতে মোহিনীরূপ ধারণ করে মুকুটমণিপুর। সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের দৃশ্যও দেখার মতো। কিন্তু এইসময় আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকায় আমরা কিছুই দেখতে পাইনি। বসে বসে একভাবে তাকিয়ে আছি জলের দিকে, রং-এর সঙ্গে রূপও বদলাচ্ছে। কখনও সূর্যালোকে চিকচিক করছে আবার আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হলে ঘোলাটে, কিছুক্ষণ পর ঘোলাটে নীল, নীলের সঙ্গে মিশে গিয়ে হালকা গোলাপী, কমলা কত রং! 

দূরের টিলায় সন্ধ্যা নামছে। সামনেই আরণ্যক পরিবেশে সোনাঝুরি প্রকৃতিবীক্ষণ কেন্দ্রের বাংলোটি কেমন ভুতুড়ে বাড়ির মত লাগছে, দারুণ লোকেশন। একটু পরেই ঝুপ করে অন্ধকার ঘিরে ধরে। দূর থেকে ভেসে আসে মাদলের দ্রিম দ্রিম ধ্বনি। মনটা কেমন করে ওঠে, ছুটে যায় দূর সুদূরে। মশার কামড়ে সম্বিৎ ফিরে আসতে হোটেলে ফেরার পথ ধরি। ঘুটঘুটে অন্ধকার। বাঁধের ধার দিয়ে পঞ্চাশটিরও বেশি আলোক স্তম্ভ অর্ধবৃত্তাকারে সাজানো কিন্তু একটিও জ্বলছে না। সিজনে জ্বলে নিশ্চয়ই। রাস্তার দু-ধারে সারি সারি ঘর সাজানোর সামগ্রীর দোকান, বেশিরভাগই বন্ধ। দু-চারটি খাবার হোটেল আর দু-একটি রকমারি জিনিসের দোকান যেমন বিস্কুট, জলের বোতল এইসব। জায়গাটি সম্পূর্ন পর্যটক নির্ভর। বাজার এলাকা বলতে ১১ কিমি দূরে খাতরা।

mukutmani pur

ঝিলিমিলি-তালবেড়িয়া ড্যাম

ভেবেছিলাম খুব ভোরে উঠে সূর্যোদয় দেখতে যাবো কিন্তু উঠে দেখলাম বৃষ্টি পড়ছে। একটু বেলা বাড়তে চরচড়ে রোদ উঠল। একটা গাড়ি জোগাড় করে বেরিয়ে পড়লাম ঝিলিমিলি আর তালবেড়িয়া ড্যাম দেখতে। রাস্তার দু-পাশে সবুজের সমারোহ দেখতে দেখতে আর একটার পর একটা দীঘি পার হতে হতে পৌঁছে গেলাম রাণীবাঁধ। দূরত্ব ১৭ কিমি। রাণীবাঁধ থেকে কিছুটা যাওয়ার পর আবার সবুজের বিস্তার। এক এক করে পার হয়ে যাচ্ছি ১ নং, ২ নং, ৩ নং ভিউপয়েন্ট। ভিউপয়েন্ট থেকে দূরে টিলার দৃশ্য আর কংসাবতী নদীর দৃশ্য দেখে পৌঁছে যাই সুতানের প্রবেশদ্বারে। 

এখান থেকে পথ গেছে ৬ কিনি গভীর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। ইচ্ছে থাকলেও উপায় না থাকায় আমরা জঙ্গলের পথে না ঢুকে সোজা ঝিলিমিলি যাওয়ার পথ ধরলাম। সুতানে যেতে হলে জীপ গাড়ি প্রয়োজন, ছোট গাড়ি যাবে না কারণ রাস্তা খারাপ। আর এখন বর্ষাকাল। মুকুটমণিপুর থেকে ঝিলিমিলির দূরত্ব ৩৭ কিমি। আরো কিছুটা পথ গিয়ে পাকা রাস্তা ছেড়ে গাড়ি গিয়ে পড়ল গ্রামের মধ্যে এবড়ো খেবড়ো পাথুরে রাস্তায়। একে একে মাটির চালঘর পেরিয়ে যাচ্ছি, কোথাও খড়ের ছাউনি, কোথাও টিনের আবার এক একটা দোতলা মাটির বাড়ি। উন্মুক্ত প্রান্তরে গাড়ি এসে দাঁড়ালো। 

এসে গেছি তালবেড়িয়া ড্যাম। তাহলে, ঝিলিমিলি?! ড্রাইভার দাদা বললেন ফেরার পথে দেখাবেন। অর্থাৎ আমরা ঝিলিমিলি পেরিয়ে এসেছি।বাঁধানো সিঁড়ি দিয়ে উঠে সামনেই দেখি টিলায় ঘেরা আরণ্যক পরিবেশে এক টলটলে জলের সরোবর। এই প্রত্যন্ত প্রান্তরে এমন জলাশয়! সামনে দিয়ে দুদিকের দুইটি রাস্তার একটি মিশে গেছে জলে আর একটি হারিয়ে গেছে জঙ্গলে। আসলে বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, মেদিনীপুরের প্রান্ত সীমায় অবস্থিত এই তালবেড়িয়া ড্যাম। এখান থেকে ফিরতি পথে ৬ কিমি যেতে পৌঁছে গেলাম ঝিলিমিলির রিমিল রেস্ট হাউসের দোরগোড়ায়। 

চারিদিকে গাছ-গাছালিতে ছাওয়া কি নিরিবিলি পরিবেশ। শান্ত-সবুজ-নির্জনে যারা সময় কাটাতে চান তাদের নিশ্চিত ঠিকানা ঝিলিমিলির রিমঝিম পরিবেশে রিমিল রেস্ট হাউস। পর্যটক আবাসটির পিছন থেকে কংসাবতী নদীর প্রেক্ষাপটে প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে ভালো লাগবে। এখান থেকে ফিরে চলি অম্বিকানগর। অম্বিকানগর থেকে মুকুটমণিপুর ৫ কিমি। এখানে দুটি মন্দিরের একটিতে অম্বিকা দেবী ও একটিতে সাবিত্রী দেবীর মূর্তি। আর আছে রাজা রাইচরণ ধবলদেবের ভগ্ন রাজবাড়ি। 

এবার গোড়াবাড়ি বাসস্ট্যান্ড থেকে কিছুটা এগিয়েই আমাদের হোটেলের সামনে গাড়ি ছেড়ে দিলাম। এখানেই আমাদের এবারের মতো মুকুটমণিপুর ভ্রমণ শেষ হলো। আগামীকাল বিকেলে বাঁকুড়া স্টেশন থেকে রূপসী বাংলা ধরে ঘরে ফেরার পালা।   তবে নদীর জল আর চাঁদের আলোর  মাখামাখি কিংবা আকাশের রং আর সূর্যের আলোর সঙ্গে তালমিলিয়ে কাঁসাই নদীর রূপ আর রং বদলানো দেখে ছোট্ট অবসর যাপনের জন্য আবার আসতে হবে মুকুটমণিপুর।


কখন যাবেন

মুকুটমণিপুর যাওয়া যায় বছরের যেকোন সময়। তবে খুব গরমের সময় বাদ দিয়ে গেলে ভালো। 


কিভাবে যাবেন 

ধর্মতলা থেকে সরাসরি বাস যাচ্ছে মুকুটমণিপুর। 

ট্রেনে গেলে বাঁকুড়া নামতে হবে। হাওড়া থেকে রাতের আদ্রা-চক্রধরপুর প্যাসেঞ্জার ট্রেনটি বেশ ভালো। রূপসী বাংলা ভোর ৬-২৫ এ সাঁতরাগাছি ছেড়ে বাঁকুড়া পৌঁছয় বেলা ১০ টা নাগাদ। এছাড়া ব্ল্যাক ডায়মন্ড ধরে দূর্গাপুর পৌঁছে ব্রেক-জার্নি করেও বাঁকুড়া পৌঁছনো যায়। অথবা খড়্গপুর হয়ে লোকাল ট্রেনে। 

বাঁকুড়া স্টেশন থেকে রিক্সা নিয়ে যেতে হবে মাচানতলা বাসস্ট্যান্ড। এখান থেকে কিছুক্ষণ অন্তর অন্তর খাতরা হয়ে মুকুটমণিপুর যাওয়ার বাস ছাড়ছে।


কোথায় থাকবেন

 পিয়ারলেস রিসর্ট, বন উন্নয়ন নিগমের সোনাঝুরি প্রকৃতিবীক্ষণ কেন্দ্র থাকার পক্ষে খুবই ভালো কিন্তু ভাড়া খুব বেশি।

ইরিগেশন ডিপার্টমেন্টের কংসাবতী ভবন, পি-এইচ-ই র ইন্সপেকশন বাংলো, যুব আবাস বা ইয়ুথ হোস্টেল।

এছাড়া দু-একটি বেসরকারি হোটেল আছে। হোটেল অপরাজিতা, হোটেল আম্রপালি, হোটেল গ্রিন পার্ক ইত্যাদি।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন