পায়ে পায়ে হর-কি-দুনের পথে | Har Ki Dun Trek, Garhwal, Uttarakhand

দেরাদুন থেকে সাঁকরি, তালুকা, সীমা হয়ে হর-কি-দুনের পথে

দুন এক্সপ্রেস যথারীতি ৬ ঘন্টা দেরীতে দেরাদুন ঢুকলো। ভেবেছিলাম পৌঁছে পুরোলা পর্যন্ত এগিয়ে যাবো, কিন্তু তা আর হলো না। দেরাদুনেই থাকতে হলো সেদিন। পরদিন ভোর ৫ টার বেসরকারী বাসে রওনা দিলাম সাঁকরির উদ্দেশ্যে। পুরোলা হয়ে সাঁকরি যেতে প্রায় ১১ ঘন্টা। আবার মুসৌরি হয়েও যাওয়া যায়, একই সময় লাগে। এ পথের অপার সৌন্দর্য্য দেখার মতো। ফেরার সময় এপথেই ফিরব।

বারকোট থেকে একটা পথ চলে গেছে জানকীচটি হয়ে যমুনোত্রী। আর একটা পথ গেছে সাঁকরির দিকে। হাতে দুদিন বেশি থাকলে হর-কি-দুন থেকে ফেরার সময় যমুনোত্রী ঘুরে নেওয়া যায়। 

Har Ki Dun Trek, Garhwal, Uttarakhand
হর-কি-দুন, গাড়োয়াল.. উত্তরাখণ্ড

সাঁকরি থেকে তালুকা - হর-কি-দুন উত্তরাখন্ড-র পথে

বিকেলে সাঁকরি পৌঁছে ছোট গাড়ি ভাড়া করে খুব ধীর গতিতে প্রায় ১ঘন্টা পর পৌঁছলাম তালুকা। এই ১১ কিমি রাস্তা খুবই খারাপ। রাতের আশ্রয় তালুকা GMVN এর গেস্ট হাউস। খুবই সাধারণ মানের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা। রাতের নিশ্ছিদ্র অন্ধকার আর অসহ্য নির্জনতাকে সঙ্গী করে ঘুমিয়ে পড়লাম।


হাঁটাপথের শুরু, তালুকা থেকে সীমা

সকালের চা-জলখাবার সেরে প্রায় ৯ টা নাগাদ শুরু হল আমাদের প্রথম দিনের ট্রেকিং।  সঙ্গী আমাদের গাইড বাহাত্তরজি, এ পথের অনেক পুরনো এবং অভিজ্ঞ মানুষ। ওসলা গ্রামের বাসিন্দা। তালুকা থেকে একটু নীচে নেমে বেশ অনেক দূর পর্যন্ত বাঁধানো পথ চলে গেছে। পথের দুধারে সবুজ প্রকৃতি আর পাখির কাকলি। কিছুক্ষণ হাঁটার পর বাঁদিকে সঙ্গী হলো সুপিন নদী। ৯ কিমি হাঁটার পর গাঙ্গার গ্রামে বিরতি। দুপুরের খাবার চা-ম্যাগি। এখান থেকে সীমা ৪ কিমি। সীমাতেই রাতের বিশ্রাম। GMVN গেস্ট হাউস আগেই বুক করা আছে। GMVN এর পাশেই ফরেস্ট বাংলো। সামনে একটি খাবারের দোকান। এখানে নদীর গর্জন বেশ তীব্র। নদীর ওপর ব্রীজ পেরিয়ে বাঁদিকে ১ কিমি ওপরে উঠে গেলেই ওসলা গ্রাম। এই গ্রামটি ফেরার সময় দেখার ইচ্ছে আছে।


সীমা থেকে হর-কি-দুনের পথে

চলেছি সীমা ছাড়িয়ে। আজকের হাঁটাপথ ১৪ কিমি। ব্রীজ পেরিয়ে ডানদিকে বেশ কিছুটা চড়াই পথ। দূরে অপূর্ব এক ঝরণা সবুজ পাহাড়ের গা-বেয়ে নেমে এসেছে, মাথায় তুষার মুকুট। দেখতে দেখতে এগিয়ে চলেছি। একের পর এক ছবির মতো সুন্দর আর সবুজ প্রেক্ষাপট পেরিয়ে আর বিশ্রাম নিতে নিতে এগিয়ে চলা। হঠাৎ করেই ঢুকে পড়লাম ধূ ধূ এক গমখেতের মধ্যে। মাঝখান দিয়ে সরু মেঠো পথ। চারপাশে পাহাড়ে ঘেরা। ডানদিকে সুপিন নদীর অবিরাম বয়ে চলা। বাকরোধ করার মতো সৌন্দর্য্য। তারই মধ্যে কোথাও সর্ষে খেত, তাতে প্রজাপতির উড়ে বেড়ানো। কোথাও পাহাড়ের ঢাল বেয়ে ভেড়ার দলের নেমে আসা, এ পথের নিত্য সঙ্গী। ছোট ছোট ঝরণা তো আছেই। সারাক্ষণই বোঝাই মাল নিয়ে ঘোড়ার দলের হুড়মুড়িয়ে যাওয়া-আসা লেগেই আছে। পৌঁছে গেলাম বেশ বড়োসড়ো সুন্দর এক জলপ্রপাতের কাছে। সামনেই বিশ্রামের জন্য কাঠের বেঞ্চি পাতা। এখান থেকে বেশ কিছুটা চড়াই পথ, তারপর হর-কি-দুন! দুন মানেই উপত্যকা, আর হর-কি-দুন অর্থাৎ ঈশ্বরের বাস (abode of God)। ১০ কিমি পথ চলেই এসেছি, বাকি আর ৪ কিমি। এদিকে আবহাওয়া খারাপ হতে শুরু করেছে। কালো মেঘে ঢেকে গেছে আকাশ। আকাশের অবস্থা দেখে বাহাত্তরজিও তাড়া দিচ্ছেন। আমরা আরো জোরে পা চালাতে শুরু করলাম। গন্তব্যের প্রায় ১ কিমি আগে থেকে ঝিরঝির করে বৃষ্টি হতে শুরু করল। আমরা যে যার বর্ষাতি পরে নিলাম। দূর থেকে হর-কি-দুনের GMVN গেস্ট হাউস দেখে আনন্দে কান্না পেয়ে গেলো! এরপর আবহাওয়া আরো খারাপ হতে লাগলো এবং একনাগাড়ে বৃষ্টি হতেই থাকলো। সন্ধ্যের পর বিশেষ কিছুই  করার নেই। সাঁকরির পর থেকে ইলেক্ট্রিসিটি, মোবাইল কানেক্টিভিটি কিছুই নেই। গেস্ট হাউসের কেয়ার টেকার কাম কুক ভাত-ডাল-রুটি বানিয়ে দিল। ওই খেয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লাম। সারারাত বৃষ্টি হয়েই চলেছে। টিনের চালে আওয়াজ আরো বেশি হয়, মাঝে মাঝেই ঘুম ভেঙে যাচ্ছে।

হর-কি-দুনের পথে
হর-কি-দুন থেকে মাউন্ট স্বর্গারোহিনী

মোরিন্দা তালের পথে

সকালে উঠে দেখলাম বৃষ্টি থেমে গেছে আকাশ পরিস্কার! গরম চা পান করে খোশমেজাজে বেরিয়ে পড়লাম মোরিন্দা তালের পথে। GMVN এর গেস্ট হাউস থেকে বাইরে বেরিয়ে দেখলাম ভোরের মায়া জড়ানো হর-কি-দুন। সামনেই স্বর্গীয় স্বর্গারোহিণী, হাটা পর্বত আর হর-কি-দুন শিখর। গতকাল বৃষ্টির জন্য কিছুই দেখা যাচ্ছিল না ভালো করে। ওদিক থেকে মোরিন্দা নালা এসে মিশেছে সুপিন নদীর সাথে। মোরিন্দা নালার উৎস পথেই এগিয়ে যাচ্ছি মোরিন্দা তালের দিকে। হর-কি-দুন থেকে দূরত্ব ৩ কিমি। তালের জলে তুষারশৃঙ্গের প্রতিচ্ছবি। নাম না জানা দুটি হিমালয়ান পাখির দেখা পেলাম। আশে পাশে ছড়িয়ে আছে বেগুনি রঙের আইরিশ ফুল। এদিকে আরো এগিয়ে গেলে বোরাসু পাশের পথ। বেশ কিছুক্ষণ মোরিন্দা তালের কাছে কাটিয়ে আবার ফিরে চললাম হর-কি-দুনের দিকে। এতক্ষণে রোদে ঝলমল করছে উপত্যকা, গাঢ় নীল আকাশ। উপত্যকায় ঘোড়া চড়ে বেড়াচ্ছে। দূর থেকে দেখলাম আমাদের দুদিনের আশ্রয় GMVN (গাড়োয়াল মন্ডল বিকাশ নিগম) লজ একদম স্বর্গারোহিণীর কোল ঘেঁষে।


যমদ্বার গ্লেসিয়ারের পথে

জলখাবার খাওয়ার পর ঘুরে এলাম যমদ্বার গ্লেসিয়ারের পথে কিছুটা, দূরত্ব ৬ কিমি। সামনের বিশাল এক বুগিয়াল পেরিয়ে যেতে হবে। বুগিয়াল পেরিয়ে কিছুটা এগিয়ে নদীর ধারেই বসে থাকলাম বেশ অনেকক্ষণ, তারপর আবার ফিরে এলাম। আরো একটা রাত কেটে গেল এই দেবলোকে। 


ওসলা গ্রাম

সকালবেলা ফিরে চললাম একই পথে। আজ আমরা ওসলা গ্রাম হয়ে সীমাতে নামবো। একমাত্র দূর্যোধন মন্দির নাকি এই গ্রামেই অবস্থিত। এই গ্রামের বাসিন্দারাও নাকি কৌরবদের বংশধর। সুন্দর কাঠের কাজ করা মন্দিরটি বন্ধই থাকে। বিশেষ কোনো তিথি বা অনুষ্ঠানে খোলা হয় শুনলাম। এখন এই মন্দিরটি সোমেশ্বর মন্দির নামে পরিচিত। গ্রামটি অপূর্ব শিল্পসুষমামণ্ডিত। সব বাড়িগুলোতেই সুন্দর কাঠের কারুকাজ করা। গ্রামবাসীরাও তেমনি অসাধারণ সুন্দর। যেমন মহিলাদের দেখলাম অপূর্ব সুন্দরী তেমনি সুদর্শন পুরুষরাও। ফুলের মতো সব বাচ্চারা সবসময় হাসিমুখে। বাচ্চারা লজেন্স চাইছে আর বড়োরা জ্বর আর ব্যথার ওষুধ চাইছে। যতটুকু সঙ্গে ছিল দেওয়ার চেষ্টা করলাম। তারপর নেমে এলাম সীমাতে। যদিও ওসলার কোনো হোমস্টেতেও থেকে যাওয়া যায়। 

পায়ে পায়ে হর-কি-দুনের পথে | Har Ki Dun Trek, Garhwal, Uttarakhand

ফিরে চলা

পরদিন সীমা থেকে তালুকা পৌঁছে আবার ছোট গাড়িতে সাঁকরি যাওয়ার পথে দেখলাম উপত্যকা জুড়ে রামধনুর রঙের ছটা। রাতের আস্তানা সাঁকরিতে। তালুকার থেকে সাঁকরি বেশি সুন্দর জায়গা আর থাকা-খাওয়ার সুযোগ সুবিধাও বেশি। আগামীকাল ফিরে যাবো দেরাদুন।


কিভাবে যাবেন

হর-কি-দুন (উচ্চতা প্রায় ১২,০০০ ফুট) যেতে হলে পৌঁছতে হবে দেরাদুন। দেরাদুন থেকে সাঁকরির দূরত্ব ২০০ কিমি। mido restaurent এর সামনে থেকে ভোর ৫ টায় প্রাইভেট বাস ছাড়ে, পৌঁছয় বিকেল ৪ টে। এছাড়া সরকারি বাসও আছে। দলে ভারী থাকলে গাড়ি বুক করে নেওয়া সুবিধা। সাঁকরি থেকে তালুকা এই ১১ কিমি রাস্তা ছোট গাড়ি চলে। তালুকা থেকেই হাঁটা পথের শুরু। তালুকা থেকে সীমা ১৩ কিমি। সীমা থেকে হর-কি-দুন ১৪ কিমি। ফেরা একই পথে। হর-কি-দুনে একদিন অতিরিক্ত রাখা উচিত। সেক্ষেত্রে মোরিন্দা তাল অথবা যমদ্বার গ্লেসিয়ার ঘুরে আসা যায়। হর-কি-দুন থেকে মোরিন্দা তাল ৩ কিমি। হর-কি-দুন থেকে যমদ্বার গ্লেসিয়ার ৬ কিমি। দুটো আলাদা দিকে।


কোথায় থাকবেন

সাঁকরি, তালুকা, সীমা, হর-কি-দুন সর্বত্র GMVN লজ (basic facilities) আছে। এছাড়া ফরেস্ট রেস্ট হাউস আছে। সাঁকরিতে কিছু প্রাইভেট হোটেল আছে। ওসলাতে হোমস্টেও আছে। GMVN এ না থেকে তাঁবুতে থাকতে চাইলে দুদিনের ট্রেক তিনদিনেও করা যায়। অনলাইনে GMVN লজ বুক করা যায়। এছাড়া যে কোনো রকম সাহায্য যেমন:- ঘর ভাড়া, গাইড, পোর্টার, তাঁবু ইত্যাদির জন্য এনাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন:-

বাহাত্তর জি:+919458326614

গঙ্গা রাণা:-     +919458118063

বচন রাণা:- +919458386006


কখন যাবেন

মে-জুন মাস। অক্টোবর-নভেম্বর মাস। শীতকালেও হর-কি-দুন ট্রেক করা যায়। কিন্তু অত্যধিক তুষারপাত ও ধ্বসের কারণে শীতকালীন ট্রেক মাঝে মধ্যে বন্ধও হয়ে যেতে পারে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন