হরিদ্বার থেকে উত্তরকাশী, হর্ষিল হয়ে গঙ্গোত্রী ভ্রমণ
হরিদ্বার থেকে উত্তরকাশী | Haridwar to Uttarkashi, Uttarakhand Garhwal
হরিদ্বার থেকে ছুটে চলেছি উত্তরকাশীর দিকে, দূরত্ব প্রায় ১৮০ কিমি। আমরা ঋষিকেশ, নরেন্দ্রনগর, চাম্বা, তেহরীর পথ হয়ে যাচ্ছি। এখন মে মাসের শেষ। যেমন গরম, তেমন ভিড়। চারধাম যাত্রার জন্য ঘনঘন চেকিং চলছে। তার ওপর আজ সোমবতী অমাবস্যার জন্য হরিদ্বারে তিলধারণের জায়গা নেই গতকাল থেকেই। ভিড়, জ্যাম ঠেলে ঋষিকেশ পৌঁছতেই বেশ দেরী হয়ে গেল। আমরা বোলেরো গাড়ি ভাড়া করেছি ৭-৮ জনের বসার জায়গা। এখন এই ভিড়ের সময় সবকিছুরই চড়া দাম। যেমন হোটেলের তেমন গাড়ির। গাড়ির রেট দিনপ্রতি ৫০০০ টাকা।
পড়ুনঃ পঞ্চপ্রয়াগ ছুঁয়ে বদ্রিনাথ, বসুধারার পথে
দেবপ্রয়াগের পর থেকে গঙ্গা এখানে ভাগীরথী নামে প্রবাহিত। ভাগীরথীর তীরে অবস্থিত উত্তরকাশী উত্তরাখণ্ডের এক গুরুত্বপূর্ণ জেলা সদর। বারাণসীর মতোই উত্তরকাশীতে গঙ্গা কিছুটা পথ উত্তর-বাহিনী। ফেরার পথে বিশ্বনাথ মন্দির দর্শন করে যাওয়ার ইচ্ছা আছে। শহর থেকে ৫ কিমি দূরে নেহেরু মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউট অবস্থিত, যা পর্বতারোহী ও পাহাড় প্রেমীদের জন্য আর এক তীর্থস্থান। আমরা উত্তরকাশীতে না থেকে আরো একটু প্রায় ৮ কিমি মতো এগিয়ে নেতালায় দ্বিতীয় রাত কাটালাম। গতকাল ছিলাম হরিদ্বারে। গঙ্গোত্রীর পথে নেতালা রাস্তার ওপর আর ভাগীরথীর ধারে ছোট জায়গা। তীর্থযাত্রীদের জন্যই থাকা-খাওয়ার সুব্যবস্থা আছে।
উত্তরকাশী থেকে হর্ষিল:- Uttarkashi to Harsil ,Uttarakhand Garhwal
উত্তরকাশী থেকে হর্ষিলের দূরত্ব প্রায় ৭৫ কিমি। আমাদের এবারে উত্তরাখণ্ড আসার মূল আকর্ষণ হর্ষিল। আপেল, পাইন, দেবদারু, ওক গাছে ঘেরা হর্ষিল এই পথের অন্যতম সুন্দর জায়গা হলেও এতদিন লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে গেছে। হাজার হাজার তীর্থযাত্রী গঙ্গোত্রীর পথে ছুটছেন পুণ্যের টানে কিন্তু তার সিকিভাগ মানুষও আসেন না হর্ষিলে। ঠিক যেমন জমজমাট কেদারনাথের পথে শান্ত, নিরিবিলি ত্রিযুগীনারায়ণ। তীর্থযাত্রীদের জন্য না হলেও প্রকৃতি প্রেমীদের কাছে হর্ষিল অন্যতম সেরা ঠিকানা। "রাম তেরি গঙ্গা ময়েলী"র শ্যুটিং স্পট এই হর্ষিল, বাগোরি গ্রামগুলি। সিনেমায় দৃশ্য হর্ষিলের পোস্ট অফিসটি এখনো বিদ্যমান। হর্ষিলের পথে রাজকাপুরের ছবিও দেখলাম। হর্ষিল এখনো সেই স্মৃতি বহন করে চলেছে। হর্ষিলের গাড়োয়াল মন্ডল বিকাশ নিগমের ট্যুরিস্ট লজটির অবস্থানও যথেষ্ট লোভনীয়। লজের নিজস্ব সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাওয়া যায় একেবারে ভাগীরথীর ধারে। চুপ করে বসে থাকা যায় অনেকক্ষণ। অপার শান্তির জায়গা এই হর্ষিল। তার সাথে প্রকৃতিও সঙ্গ দেয় সারাক্ষণ। পাখির কূজন, সবুজের বিস্তার, তুষার শৃঙ্গ , আপেল বাগান, নদীর বয়ে চলা সবকিছু নিয়ে হর্ষিল। হর্ষিলের বাজার এলাকাও আমার ভালো লেগেছে। কয়েকটি হোটেল, দোকানপাট নিয়ে ছিমছাম বাজার এলাকা। তবে ঘিঞ্জি নয় এখনও তেমন। নির্জনতা আমার ভালো লাগে কিন্তু এমন পাহাড়ি গ্রামে সন্ধ্যের পর কিছুই করার থাকে না তখন এই বাজার এলাকায় ঘুরতে বেশ ভালো লাগে। হর্ষিলকে এখনো গ্রাম বলা যায় কিনা জানিনা তবে এটি সামরিক এলাকাও তাই যথেষ্ট পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন। উচ্চতা প্রায় ৯০০০ ফুট। এখন যদিও আপেলের সময় নয়, বাচ্চা বাচ্চা সবুজ আপেলে ভরে আছে গাছগুলো। হর্ষিল প্রসিদ্ধ আপেলের জন্য। সকালবেলায় হালকা রোদে ভাগীরথীর গা ঘেঁষে হর্ষিলের লক্ষ্মী-নারায়ণ মন্দিরটিও বেশ ভালো লাগলো। পাহাড়ে ঘেরা আর ফুল গাছ দিয়ে সাজানো মন্দির চত্বরটি। হর্ষিলে আলাদা করে দেখার জায়গা কিছু নেই। আবার পুরো গ্রামটাই একটা ভিউ-পয়েন্ট। যেখানে চোখ যায়, চোখ আটকে যায়।
হর্ষিলকে ঘিরে:-
হর্ষিলকে ঘিরে আশেপাশের গ্রামগুলিও অদ্ভুত সুন্দর। হর্ষিলের ২ কিমি দূরে ধারালি গ্রাম, হর্ষিলের ১ কিমি দূরে মুখবা গ্রাম। শীতকালে যখন গঙ্গোত্রী মন্দির বন্ধ হয়ে যায় তখন মুখবা গ্রামেই গঙ্গামায়ের মূর্তি নামিয়ে আনা হয়।
হর্ষিল থেকে ২ কিমি হাঁটাপথে বাগোরি গ্রাম। হর্ষিল থেকে ব্রীজ পেরিয়ে বাগোরি আসার রাস্তাটা খুবই সুন্দর। ভোটিয়াদের বাস, অর্থাৎ তিব্বতিদের বাস এই বাগোরি গ্রাম। খুবই ছোট গ্রাম। গ্রামের মহিলারা হাতে বোনা সোয়েটার, টুপি বিক্রি করছে, লাইন দিয়ে দোকান। বাগোরি গ্রামের সুদৃশ্য কাঠের বাড়িগুলিতে চোখ আটকে যায়। বাগোরি গ্রাম দেখে হর-কি-দুনের পথে ওসলা গ্রামের কথা মনে পরে যায়। এমনই কাঠের বাড়িতে হোমস্টে হয়েছে বেশ কয়েকটি। একেবারে পাহাড়ি গ্রামের স্বাদ পেতে হলে থাকা যায় এখানে এসেও। তবে জিনিসপত্র নিয়ে শেষ ১ কিমি পথ হেঁটেই পৌঁছতে হবে।
নেলং ভ্যালি ও গারতাং গলি:- Nelong Valley , Gartang Gali , Uttarakhand Garhwal
একরাত হর্ষিলে কাটিয়ে গঙ্গোত্রীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই। তবে এখানে পথ মধ্যেই অন্যতম আর এক আকর্ষণ আছে। তা হল গারতাং গলি। গারতাং গলি প্রাচীন ভারতবর্ষের এক হারিয়ে যাওয়া আন্তর্জাতিক বাণিজ্য-পথ। নীচ দিয়ে প্রচন্ড শব্দে বয়ে যাচ্ছে শতাব্দী প্রাচীন জাহ্নবী গঙ্গা/ জাঢ় গঙ্গা। কয়েক হাজার ফুট খাঁড়া ওই পাহাড়টার গা কেটে কয়েক কিলোমিটার দীর্ঘ একটা ঝুলন্ত কাঠের রাস্তা তৈরি করা হয়েছিল সে যুগে, যার কিছুটা আজ অবশিষ্ট আছে। যে রুদ্ধশ্বাস পথ ধরে ব্যবসায়ীরা নেলং ঘাঁটি হয়ে লম্বা পথ গিয়ে সাংঘাতিক চোরগাদ ভ্যালি পার হয়ে পৌঁছে যেত সুদূর তিব্বতে। চলত ভারত-তিব্বত বাণিজ্য। হর্ষিল থেকে গঙ্গোত্রীর দিকে ১২ কিমি যেতে লঙ্কা। লঙ্কা ব্রীজের ঠিক আগেই গারতাং গলির হাঁটাপথ শুরু। মাত্র ২.৫ কিমি। যাওয়া-আসা মিলিয়ে ৫ কিমি। চেকপোস্টে আধার কার্ড দেখিয়ে ১৫০ টাকা টিকিট নিয়ে হেঁটে আসা যায় এই পথে। খাঁড়া রুক্ষ পাহাড়ের দেওয়াল বাঁ-দিকে, সংকীর্ণ এই পথ -- ডানদিকেই গভীর খাদ, নীচ দিয়ে বয়ে চলেছে নীলাভ সবুজ জাহ্নবী গঙ্গা। শেষের ১৩৬ মিটার পথ কাঠের সিঁড়ি আছে। শেষ পথটুকু কাঠের ব্রীজ করে আটকে দিয়েছে। আগে এই পথ ধরে আরো এগিয়ে গেলে তিব্বত পৌঁছনো যেত কিন্তু এখন শুধু ট্যুরিস্টদের জন্যই মাত্র ২.৫ কিমি পথ খুলে দিয়েছে। প্রাচীন বাণিজ্য পথের স্বাদ নিতে একবার হাঁটা যায় এই পথে।
গারতাং গলি নেলং ভ্যালির অন্তর্গত। উল্টোদিকের পাহাড় দিয়ে নেলং গ্রাম যাওয়ার গাড়িপথ। হর্ষিল থেকে গঙ্গোত্রীর দিকে যেতে লঙ্কার ৩ কিমি আগেই পরবে ভৈরবঘাঁটি। এই ভৈরবঘাঁটি থেকেই নেলং গ্রাম যাওয়ার গাড়িপথ। দূরত্ব ৩০ কিমি। তবে এপথে যেতে মিলিটারি পারমিশন লাগে। ১৯৬২ সালে ভারত-চীন যুদ্ধের পর এই রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়, তিন বছর হল আবার খুলেছে। নেলং ভ্যালির রুক্ষ পাথুরে সৌন্দর্য্যের জন্য এই অঞ্চলকে উত্তরাখণ্ডের লাদাখ বলে।
লঙ্কা থেকে গঙ্গোত্রীর দূরত্ব মাত্র ১১ কিমি। একটু সকাল সকাল হর্ষিল থেকে বেরিয়ে গারতাং গলি দেখে ওইদিনই একটু বেলা করে পৌঁছে যাওয়া যায় গঙ্গোত্রী। তবে নেলং গ্রাম গেলে একদিন বেশি সময় লাগবে।
গঙ্গোত্রী:- Gangotri ,Uttarakhand , Garhwal
আমরা গঙ্গোত্রী পৌঁছে থাকার জায়গা ঠিক করেই গেলাম মন্দির প্রাঙ্গণে। একদম ফাঁকা দেখে দর্শন সেরে নিলাম। এখন চারধাম যাত্রার পিক-সিজন সেই তুলনায় গঙ্গোত্রীতে থাকার জন্য ভিড় তেমন নেই বললেই চলে। ভেবেছিলাম হোটেল পেতে বেগ পেতে হবে কিন্তু বেশ সহজেই পেয়ে গেলাম। যদিও হোটেল প্রচুর। বেশিরভাগ দর্শনার্থী সারারাত বাস জার্নি করে এসে সকালে পুজো দিয়ে আবার বাসে করে বেরিয়ে যাচ্ছেন, তাই থাকার ভিড় কম। সারাদিনই যাত্রীদের আনাগোনা লেগে আছে মন্দির প্রাঙ্গণে। একটু বেলার দিকে দেখলাম হয় সবাই দর্শন করে বেরিয়ে যান, না হলে এসে পৌঁছন না তাই মন্দির প্রাঙ্গণ ফাঁকা আছে। আবার বিকেলবেলা মন্দির প্রাঙ্গণে এলাম আরতি দেখতে। অপরূপ সুদর্শন শিখরে সূর্যাস্ত দেখে আরতি শুরু হল। বেশ ভিড় হলেও সুন্দরভাবেই আরতি দেখতে পেলাম। "জয় গঙ্গা মাইয়া" ধ্বনিতে সরগরম হয়ে উঠল আলোকিত মন্দির প্রাঙ্গণ। এ এক অন্যরকম পরিবেশ। গঙ্গোত্রীর উচ্চতা ১০,০০০ ফুট। ভাগীরথী বা গঙ্গার উৎস গোমুখ, তপোবন, নন্দনবন, কেদারতাল ট্রেক গঙ্গোত্রী থেকেই শুরু।
সকালে আমরা আবার মন্দির প্রাঙ্গণ ঘুরে গেলাম স্নানঘাটের কাছে, আশপাশটা ঘুরে ব্রীজের ওপারে গেলাম সূর্যকুন্ড আর গৌরীকুন্ড দেখতে। ঝকঝকে আবহাওয়া, নীল আকাশ, গঙ্গা নদীর বয়ে চলা যদিও এখানে নাম ভাগীরথী, চারদিকে সবুজ প্রকৃতি, সুদর্শন শিখর সবমিলিয়ে পায়ে হেঁটে চারপাশটা ঘুরতে অনেকটা সময় কেটে গেল। ফেরার সময় আবার একটা রাত কাটাই হর্ষিলে। হর্ষিলের সৌন্দর্য্য, শান্ত পরিবেশ আমার মন কেড়ে নিয়েছে। এরপর মুসৌরি ঘুরে ফিরে যাই হরিদ্বার। তবে এইসময় মুসৌরির জ্যাম আর ভিড় দেখে মনে হল এই একদিন গঙ্গোত্রীতে থেকে গেলেই ভালো হত।
কখন যাবেন | When to visit Gangotri, Uttarakhand Garhwal
মে থেকে অক্টোবর চারধাম যাত্রার সময় এই পথে খুব ভিড় থাকে। তবে এটাই ঠিক সময়। গঙ্গোত্রী মন্দির বন্ধ থাকলেও এপ্রিল নভেম্বর ও ভালো সময়। এছাড়া হর্ষিল সারা বছর যাওয়া যায়। চারধাম যাত্রা বন্ধ থাকলে উত্তরকাশীর পর শেয়ার গাড়ি/বাসের সংখ্যা কমে যায়।
চারধাম যাত্রার সিজনে এইপথে গেলে অবশ্যই অনলাইনে বায়োমেট্রিক রেজিস্ট্রেশন করে নেবেন ও ডকুমেন্ট সঙ্গে রাখবেন। এইসময় জায়গায় জায়গায় চেকিং চলে।
কোথায় থাকবেন| Hotel at Harsil , Gangotri, Uttarakhand.
হর্ষিলে GMVN এর গেস্ট হাউস ছাড়াও বাজারে বেশকিছু প্রাইভেট হোটেল আছে। গঙ্গোত্রীতে দুটি GMVN এর গেস্ট হাউস আছে। একটি মন্দিরের একদম কাছে আর একটি সূর্যকুণ্ডের কাছে। এছাড়াও অনেক প্রাইভেট হোটেল আছে।
কিভাবে যাবেন | Best time to visit Harsil , Gangotri, Uttarakhand.
হর্ষিল/গঙ্গোত্রীর নিকটতম রেল স্টেশন হরিদ্বার/হৃষিকেশ। নিকটতম এয়ারপোর্ট দেরদুনের জলি গ্রান্ট।
সব জায়গা থেকে উত্তরকাশীর শেয়ার জিপ/বাস পাওয়া যায়। উত্তরকাশী থেকে হর্ষিল/গঙ্গোত্রীর শেয়ার জিপ/বাস পাওয়া যায়। হরিদ্বার/হৃষিকেশ থেকে সরাসরি গঙ্গোত্রীর বাস পাওয়া যায় চারধাম যাত্রার সময়।
যাত্রাপথের দূরত্ব | Distance between
Haridwar to Uttarkashi 180 km
Uttarkashi to Harsil 75 km