এবার হিমাচল প্রদেশ আসার প্রধান কারণ তীর্থণ উপত্যকা আর সাইঞ্জ উপত্যকা। এই উপত্যকা গুলি বিভিন্ন ট্রেক পথের মাধ্যমে পরস্পর সংযুক্ত। এখন এপ্রিলের শুরুতে ভিড় তেমন নেই। তীর্থণ নদীর ধারে জিভিতে একরাত থাকার পর চলে গিয়েছিলাম সেরাজ উপত্যকার সোজা গ্রাম, জালোরি পাস হয়ে সেরোলসর লেকের পথে।
এরপর আবার তীর্থণ নদীর তীর ধরে গ্রেট হিমালয়ান ন্যাশনাল পার্কের প্রবেশদ্বার গুসাইনিতে একরাত কাটিয়ে চলে যাই সাইঞ্জ উপত্যকা (Sainj Valley)।
সাইঞ্জ উপত্যকার প্রধান আকর্ষণ সানগড় (Shangarh) তৃণভূমি আর এই অঞ্চলটি গ্রেট হিমালয়ান ন্যাশনাল পার্কের পাদদেশে অবস্থিত। গুসাইনের মতোই সানগড় থেকেও গ্রেট হিমালয়ান ন্যাশনাল পার্ক ট্রেক শুরু হয়। আগেই বলেছি এই উপত্যকাগুলি -- তীর্থণ, সাইঞ্জ, পার্বতী উপত্যকাগুলি বিভিন্ন ট্রেক পথের মাধ্যমে একে অপরের সাথে যুক্ত। গ্রেট হিমালয়ান ন্যাশনাল পার্ক, ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের তকমায় ভূষিত।
তীর্থণ উপত্যকা থেকে সাইঞ্জ উপত্যকার পথে|
গুসাইনিতে একরাত কাটিয়ে অট যেতে হবে আবার আমাদের। গুসাইনি থেকে লারজি অবধি একই পথ। এরপর লারজি থেকে তীর্থণ আর সাইঞ্জ উপত্যকার রাস্তা পৃথক হয়ে গেছে। আমরা আজ যাবো সাইঞ্জ উপত্যকার সানগড়ে। আমরা যেহেতু বাসে যাতায়াত করছি, মাঝপথে লারজি থেকে জিনিসপত্র নিয়ে ওঠার একটা সমস্যা আর জায়গা পাবো কি-না সেইজন্য একদম স্টপেজ থেকেই উঠবো ঠিক করি। তাই অট এগিয়ে যাই। অট থেকে সানগড় ৩৫ কিমি। কুলু থেকে একটা বাস টানা সানগড় আসে। দুপুর ২-১৫ নাগাদ কুলু বাসস্ট্যান্ড থেকে ছেড়ে সাইঞ্জ পৌঁছয় বিকেল ৪-টে নাগাদ। এই বাসটিতে অট বাসস্ট্যান্ড থেকেও ওঠা যায়। আমরা অট অনেকটাই আগে পৌঁছে গেছি তাই টানা বাসের অপেক্ষা না করে অন্য একটি বাসে উঠি সাইঞ্জ যাওয়ার জন্য।
অট থেকে সাইঞ্জ যাওয়ার বাস সহজেই পাওয়া যায়। সাইঞ্জ বেশ বড়ো জায়গা এখানে। বানজার, অট, জিভি, সোজা সব জায়গা থেকেই সাইঞ্জ যাওয়ার বাস পাওয়া যায়। অট থেকে সাইঞ্জ এর দূরত্ব প্রায় ১৮ কিমি। সাইঞ্জ থেকেও সানগড়ের বাস সেই বিকেলে ওই একটাই বাস যেটা কুলু থেকে আসছে। তাই আর অপেক্ষা না করে একটা গাড়ি ঠিক করি এখানকার ট্যাক্সি ইউনিয়ন থেকে। সাইঞ্জ থেকে সানগড় যাওয়ার ভাড়া ৮০০ টাকা। সাইঞ্জ থেকে রোপা কমপ্লেক্স হয়ে সানগড় ১৭ কিমি।
এই এপ্রিলেও দেখলাম গ্রামের কিছু বাড়ির গাছে কমলালেবু ভর্তি। আর এইসময় তো আপেল, ন্যাসপাতি গাছে গোলাপী আর সাদা ফুলে নুয়ে আছে। তার ফাঁক দিয়ে তুষার শিখরের উঁকি ঝুঁকি। সাইরোপা আর রোপা কমপ্লেক্স কিন্তু একেবারেই দুটো আলাদা জায়গা। কিন্তু আমি এক ভেবে গুলিয়ে ফেলেছিলাম। সাইরোপা বানজার থেকে গুসাইনি যাওয়ার পথে, এখান থেকে ছই জলপ্রপাত যাওয়ার রাস্তা। অর্থাৎ সাই রোপা তীর্থণ ভ্যালির অন্তর্গত। এখানেও বেশ কিছু থাকার জায়গা হয়েছে। রোপা কমপ্লেক্স সাইঞ্জ ভ্যালির অন্তর্গত। সাইঞ্জ থেকে সানগড় যাওয়ার পথে। আমাদের ড্রাইভার দাদা জ্ঞান-জি সারাক্ষণ গল্প করতে করতে গাড়ি চালাচ্ছেন। খুবই ভালো মানুষ। এদিককার বেশ কিছু ট্রেক রুট সম্বন্ধে ওনার বেশ জ্ঞান। একসময় ভলিবল খেলতেন, শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। খুবই নম্র, ভদ্র। উনি নিজেই বার বার বলছেন "কোথাও দাঁড়ানোর হলে বলবেন। গাড়ি ভাড়া করে যাওয়ার এটাই তো সুবিধা।" গল্প করতে করতে আমরা সানগড় পৌঁছে গেলাম।
আরও পড়ুনঃ
নাগাল্যান্ডের জুকু ভ্যালি (DZUKOU VALLEY NAGALAND) ট্রেক
সাইঞ্জ উপত্যকার প্রধান আকর্ষণ সানগড় | Shangarh in Sainj Valley
পথেই ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি শুরু হয়েছিল। একটা চায়ের দোকান আছে বাসস্ট্যান্ডে, এখানে চা খেলাম। এই এতক্ষণে সানগড়ে এসে কিছু বাঙালীর দেখা পেলাম। এই কদিনে জিভি, সোজা, গুসাইনিতে কোনো বাঙালী দেখিনি। সবই ওই পাঞ্জাব, হরিয়ানা, দিল্লী থেকে সপ্তাহান্তিক সফরে (week end trip) এসেছেন গাড়ি নিয়ে। তবে মে-জুন মাসে গরমের ছুটির সময় কিন্তু ভালোই ভিড় হয়।
বাসস্ট্যান্ড বলতে তেমন কিছুই নয়, সেই যে কুলুর বাসটা টানা সানগড় আসে বলেছিলাম ওই বাসটা সারারাত এখানে থাকে আবার সকাল ৮-টা নাগাদ ছেড়ে কুলু যায়। এখানে কোথাও কিন্তু শেয়ার গাড়ির ব্যবস্থা নেই। অর্থাৎ রুটের কোনো শেয়ার গাড়ি যায় না শুধুই বাস। এটা স্পিতি ঘোরার সময়ও লক্ষ্য করেছিলাম একই ব্যাপার। আমরা হোটেল প্যারাডাইসে ঘর নিলাম ১৫০০ টাকা করে, এখানে দু-দিন থাকবো।
একটু ঝড়-বৃষ্টি হতেই লোডশেডিং হয়ে গেল। দূরে পাহাড় লাল হয়ে গেছে, সূর্যাস্ত হচ্ছে। দিগন্ত-বিস্তৃত ঢেউ খেলানো সবুজ তৃণভূমির প্রায় শেষ প্রান্তে সাংচুল মহাদেবের মন্দির। মন্দিরের পিছনে ধৌলাধার পর্বতমালার তুষারধবল শোভা। তৃণভূমিকে গোল করে ঘিরে আছে পাইন গাছের সারি। অনেকটা খাজিয়ারের মতো হলেও এই তৃণভূমি অনেকটাই বড়ো আর বিস্তৃত। বর্ষার সময় বা বর্ষার পরে এই সবুজ তৃণভূমি আরও ঘন সবুজ হয়ে ওঠে। এখানে বসেই কেটে যাবে সারাদিন। সানগড়ের উচ্চতা প্রায় ৭০০০ ফুট।
হোটেলে ফিরে কফি-পকোড়া নিলাম। খেতে খেতে হোটেলের বারান্দা থেকেই দেখলাম কুলুর ওই বাসটা এসে পড়লো। আমরা আগামীকাল এখানেই আছি, পরশু এই বাসেই ভুন্টার যাবো। সারারাত লোডশেডিং রইল।
How to reach Shangarh from Sainj?
What is Shangarh famous for?
বরসানগড় জলপ্রপাতের পথে | Barshangarh Waterfall
সকালে জলখাবার সেরে মিডো'তে (meadow) গেলাম। বেশ কিছুক্ষণ সময় কেটে গেল সানগড়ের সবুজ প্রান্তরে আর মন্দিরে। মন্দিরটি কাঠের তৈরি আর মহাদেবের বিগ্রহও কাঠের তৈরি। অপূর্ব সুন্দর! মেডো'র মধ্যে দিয়েই ওদিকে গ্রামে যাওয়ার হাঁটা পথ চলে গেছে। এই পথ ধরে আমরা এগিয়ে গেলাম বরসানগড় জলপ্রপাত দেখতে।
আসল উদ্দেশ্য রাস্তাগুলো হেঁটে ঘোরা। অনেকেই গাড়ি নিয়ে দেখতে যাচ্ছেন, দূরত্ব ৩ কিমি। রাস্তাটা হেঁটে যেতেই বেশি ভালো লাগছে। কি সুন্দর হয়ে আছে চারপাশটা বসন্তের রঙে রঙিন। চাষের জমি, দূরে পাহাড়ের সারি, বরফচূড়া, গ্রামের ঘরবাড়ি, হোমস্টে, সরষে খেত, রডোডেনড্রন, আপেল ন্যাসপাতি ফুল সব মিলিয়ে রঙে রঙে ভরে আছে সানগড়। এক জায়গায় গাড়িপথ শেষ হয়ে পাহাড়ের ওপর কিছুটা উঠতে হয় তারপর আবার নেমে যেতে হয় জলপ্রপাতের কাছে পৌঁছনোর জন্য।
শেষের এই হাঁটা পথটুকু যেতে ২০ মিনিট লাগে। গাড়ি স্ট্যান্ডে দুটো দোকান চা-জলখাবার, চিপস, কোল্ড্রিংকস -এর। আমরা চা নিলাম। দোকানের দুটি বাচ্চা মেয়ে গ্রাম থেকে অনেক লাল রডোডেনড্রন সংগ্রহ করে এনেছে। এগুলো ওরা ভুন্টারে পাঠাবে জুস্ তৈরির জন্য। পাহাড়ে ওঠার সময় গাছের একটা খয়েরি রঙের giant squirrel দেখলাম।
এক পাহাড় থেকে আর এক পাহাড়ের নীচে নেমে দেখতে পেলাম জলপ্রপাতটি পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসছে। কিছুক্ষণ এখানে কাটিয়ে আবার নীচের দোকানে চলে এলাম। এখানে ম্যাগি আর সিড্ডু খেলাম। সিড্ডু আটা দিয়ে তৈরী অনেকটা পিঠের মতো তবে বড়ো করে বানিয়ে কেটে কেটে দেয়। ভেতরে বাদাম, কাজু, পেস্তা, আখরোটের পুর থাকে। চাটনি বা ঘি দিয়ে খেতে হয়। এখানে দেখলাম দেবতার প্রতিভূ এক গ্রাম থেকে লাপা নামক গ্রামে বেশ বাজনা বাজিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। জানলাম গ্রামের কারোর মানত/মানসিক থাকলে এরকম দেবতা আনিয়ে পুজো দেওয়া হয়।
লাপার সরু রাস্তা চলে গেছে পাহাড়ের গা বেয়ে। এটাও একটা ট্রেক পথ গ্রেট হিমালয়ান ন্যাশনাল পার্কের অন্তর্গত। এরকম আরো আছে, যেমন পুন্ড্রিক লেক ট্রেক। মনে হয় চলে যাই এদের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে সব দেখি হিমালয়ের অলি গলি! কিন্তু তা আর হয় না। আগামীকাল সকাল ৮-টার বাসে ভুন্টার হয়ে কাসোল যাবো।
সানগড় বেড়াতে কখন যাবেন | Best time to visit Shangarh in Sainj Valley Himachal Pradesh
সানগড় সারাবছরই যাওয়া যায়। ঘন সবুজ কার্পেটে মোড়া সানগড় তৃণভূমি দেখতে হলে যেতে হবে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাস। তবে বর্ষার সময় রাস্তা খারাপ, ধ্বস, লোডশেডিং এসব মাথায় রেখে যাওয়া উচিত। অক্টোবর ও বেশ ভালো সময়। পরিস্কার আবহাওয়ার জন্য নভেম্বর-ডিসেম্বর। বরফাবৃত সানগড় দেখতে হলে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারী। এছাড়াও মার্চ-এপ্রিল ভালো সময়। মে-জুন পিক সিজন।
When to visit Shangarh?
সাইঞ্জ উপত্যকার সানগড় কিভাবে যাবেন | How to visit Shangarh in Sainj Valley Himachal Pradesh
নিকটতম রেলস্টেশন চন্ডীগড়। আর নিকটতম বিমানবন্দর ভুন্টার, চন্ডীগড় । ট্রেনে বা প্লেনে চন্ডীগড় পৌঁছে মান্ডি-অট হয়ে সাইঞ্জ উপত্যকা পৌঁছনো যায়।যেকোন ট্রেনে বা প্লেনে দিল্লী পৌঁছেও বাসে বা গাড়ি ভাড়া করে সানগড় ঘুরে নেওয়া যায়। মানালি, কাসোল বা সিমলার দিক দিয়ে এলে কুলু পৌঁছে, কুলু থেকে টানা বাস যায় সানগড়। কুলু থেকে একটাই টানা বাস যায় সানগড়। দুপুর ২-১৫ নাগাদ কুলু বাসস্ট্যান্ড ছেড়ে সাইঞ্জ পৌঁছয় বিকেল ৪-টে নাগাদ আর সানগড় পৌঁছতে প্রায় ৬-টা বাজে।
গাড়ি ভাড়া করলে জ্ঞান জির সাথে যোগাযোগ করতে পারেন।
জ্ঞান ধামী (Gyan Dhami)
Ph no :- 7807413913
সানগড়ে থাকার জায়গা | Hotel/Homestay in Shangargh, Himachal Pradesh
সানগড়ে আমরা ছিলাম বাজারের কাছে প্যারাডাইস হোমস্টে (Paradise Home Stay )
Phone no
8091427327
9816217661
এছাড়াও মিনা হোমস্টের অবস্থান (location) বেশ ভালো। মাড হোস্টেল এন্ড ক্যাফে (Mud Hostel & Cafe), স্নো লাইন হোমস্টে (Snow Line Home Stay) ছাড়াও গ্রামের মধ্যে কিছু হোমস্টে আছে। গ্রামের মধ্যে গেলে কিছুটা পথ হেঁটে যেতে হবে। আমরা যেখানে যেখানে ছিলাম এই রুটে হোমস্টে লেখা থাকলেও থাকা ও খাওয়ার খরচ আলাদা করেই নিয়েছিল, বেশিরভাগ হোটেলে যেমন হয়।