হিমাচল প্রদেশ একটি বিশাল ও বৈচিত্র্যময় রাজ্য। এর আনাচে কানাচে ছড়িয়ে আছে সৌন্দর্য্য। সিমলা-কুলু-মানালি-কাসোল-ডালহৌসি-ধর্মশালা বেশ জনপ্রিয় টুরিস্ট স্পট। লাহুল-স্পিতির সৌন্দর্য্য যেমন ভয়ঙ্কর, রুক্ষ তেমনি কিন্নরের সৌন্দর্য্য সম্পূর্ণ আলাদা। এসব ছেড়ে এখনো অনেক জায়গা লুকিয়ে আছে রূপের ডালি সাজিয়ে। একেবারে প্রকৃতির কোলে, হৈ-হট্টগোল ম্যালের ভিড় থেকে অনেক দূরে। যেসব জায়গা তুলনামূলকভাবে কম পরিচিত, নেই কোনো HPTDC র হোটেল। তারমধ্যে তীর্থণ ভ্যালি অন্যতম। আমাদের যাত্রাপথ এবার তীর্থণ নদীর পথ ধরে হলেও একই যাত্রায় আমরা সেরাজ উপত্যকা , সাইঞ্জ উপত্যকা, পার্বতী উপত্যকা ছুঁয়ে যাবো। এর বিস্তার এত বেশি তাই ছুঁয়ে যাবো বলাই ভালো! প্রত্যেকটি জায়গার সৌন্দর্য্য আলাদা। উঁচু পাহাড়ের সারি, পাইন-দেবদারু গাছে ছাওয়া পথ, খরস্রোতা নদীর বয়ে চলা এই সব মিলিয়ে তীর্থণ ভ্যালি।
চণ্ডীগড় থেকে অট | Chandigarh to Aut.
হাওড়া-কালকা নেতাজি এক্সপ্রেস মাঝরাতে আমাদের চণ্ডীগড় নামিয়ে দিয়ে এগিয়ে গেল কালকার দিকে। যারা টয় ট্রেনে সিমলা যান তাদের পক্ষে কালকা স্টেশনে নামলে সুবিধা অথবা গাড়ি রিজার্ভ করা থাকলে। পাবলিক-ট্রান্সপোর্টে সিমলা-মানালি যেতে চাইলে চণ্ডীগড় নামলেই সুবিধা। এদিক থেকে বাসের সুবিধা বেশি। আমরা রাত ১-৩৫ থেকে ভোরের আলো ফোটা অবধি স্টেশনের ওয়েটিং -রুমে অপেক্ষা করতে থাকি। এপ্রিলের শুরু এখন, তবুও ভোরের দিকে বেশ ঠান্ডা। ৬-টা নাগাদ স্টেশন ছেড়ে বেরিয়ে একটা অটো নিয়ে যাই বাসস্ট্যান্ডে, ভাড়া ২০০ টাকা। চণ্ডীগড় স্টেশন থেকে চণ্ডীগড় ISBT-43 বাসস্ট্যান্ড প্রায় ১০ কিমি। অটোতে যেতে যেতে একটা হালকা গরম-জামা সত্ত্বেও বেশ ঠান্ডা লাগছে। বাসস্ট্যান্ড পৌঁছে আমরা পাঞ্জাব-রোডওয়েজ এর (punbus) বাসে অট যাওয়ার টিকিট নিলাম ৪৯০ টাকা করে, তিনজনের ১৪৭০ টাকা। এরপর কিছু হালকা খাবার কিনে বাসে উঠে সিটে বসে পরলাম। সকাল ৭ টার সময় বাস ছাড়লো। ৮-৩০ টার পর থেকে বেশ চড়া রোদ লাগতে লাগলো। এভাবে পুরো পথটাই যেতে হলো। আমরা তিনজনের একসঙ্গে সিট নিয়েছি ড্রাইভারের পিছনে, ডানদিকে। বাঁ-দিকে যেখানে দুটো করে সিট আছে সেদিকটা নিলে রোদ্দুর লাগবে না। জিনিসপত্র কিন্তু বাসের ভেতর নিজের কাছেই রাখতে হবে পায়ের কাছে বা ওপরে ৱ্যাকে। বাসে কোনো ডিকি নেই, আগে থাকতো। এক্ষেত্রে লাগেজ কম হলে সুবিধা। বড়ো সুটকেশ থাকলে খুব অসুবিধা হবে।
সিসু, লাহুল উপত্যকা হিমাচলপ্রদেশ ভ্রমণ
তীর্থন নদীর তীর ধরে | Tirthan River , Himachal Pradesh
বিলাসপুর, সুন্দরনগর, মান্ডি হয়ে রাস্তা চলে গেছে অট। চণ্ডীগড় থেকে মান্ডি প্রায় ২০০ কিমি। মান্ডি পেরিয়ে পান্ডোহ বাঁধের অপরূপ দৃশ্য দেখতে দেখতে আর ছবি তুলতে তুলতে এগিয়ে যাই অটের দিকে। মান্ডি থেকে অটের দূরত্ব ৩৮ কিমি। অট-টানেলে ঢোকার ঠিক মুখে ডানদিকে একটা রাস্তা চলে গেছে বানজার ভ্যালির দিকে। এটাই আমাদের জিভি হয়ে সোজা-জালোরি পাসে যাওয়ার রাস্তা। অর্থাৎ তীর্থন ভ্যালির রাস্তা। তবে আমরা যেহেতু বাসে যাচ্ছি তাই এভাবে মাঝপথে না নেমে টানেল পেরিয়ে একেবারে অট বাসস্ট্যান্ডেই নামলাম। একটু এগিয়ে বানজার-জিভি-সোজা যাওয়ার বাসস্ট্যান্ড আলাদা। বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছেই জিভির বাস পেয়ে গেলাম। এখানে সব বাসেই লাগেজ নিজেদের বসার জায়গার নীচে বা পাশে অথবা ওপরে ৱ্যাকে ছোট ব্যাগ রাখতে হবে।আলাদা কোনো লাগেজ রাখার জায়গা নেই, এটা খুবই অসুবিধাজনক। অট থেকে বানজার ২৭ কিমি আর বানজার থেকে জিভি ৮ কিমি। আবার অট টানেল পেরিয়ে এসে তীর্থন ভ্যালিতীর্থন ভ্যালি যাওয়ার রাস্তাটা ধরলাম। HRTC বাসে মহিলাদের বাস ভাড়া অর্ধেক। অট থেকে জিভির বাস ভাড়া ৭০ টাকা আর মহিলাদের ৩৬ টাকা।
জিভি, হিমাচল প্রদেশ কিভাবে যাবেন? Jibhi Village, Himachal Pradesh
এইপথে নিজেরা গাড়ি ভাড়া করে যাওয়া-আসা করলে বানজার থেকে জিভির দিকে ৩ কিমি মতো এগিয়ে প্রকৃতির মাঝে দেখে নেওয়া যায় শৃঙ্গঋষি মন্দির। সবুজ উপত্যকার মাঝে তিনতলা বিশিষ্ট এই মন্দির থেকে পারিপার্শ্বিক দৃশ্য খুব সুন্দর। মূল রাস্তা থেকে কিছুটা পথ হেঁটে যেতে হবে এই মন্দিরে পৌঁছতে হলে।এখান থেকে আরো ৩ কিমি হাঁটা পথে যাওয়া যায় চেহনি কোঠি। এটি একটি কাঠের তৈরী স্থাপত্য। টাওয়ারের মতো দেখতে। আগে এটি সাততলা বিশিষ্ট উঁচু ছিল কিন্তু ভূমিকম্পে ভেঙে গিয়ে এখন পাঁচতলা অবধি আছে। টাওয়ারে ওঠার সিঁড়ি আছে। জিভিতে যাওয়া-আসার পথে গাড়ি ভাড়া করে এগুলি দেখে নেওয়া যায়। এছাড়াও জিভি থেকে ৮ কিমি বাহু গ্রাম পর্যন্ত গাড়িতে গিয়ে হাঁটা পথে বালো নাগ মন্দির ও একটি লেক ঘুরে আসা যায়। জিভি থেকে ১ কিমি দূরে ভালাগ্রাণ গ্রামেও হোমস্টে আছে জঙ্গলে ঘেরা আরো নির্জন পরিবেশে। জিভি থেকে ২-৩ কিমি ওপরে তান্ডিতে আছে ট্রি-হাউস।
How do I go to Jibhi from Chandigarh?
How to reach aut to Jibhi?
সারা রাত নদীর ধারে
জিভিতে আমরা মূল রাস্তা থেকে একটু নেমে তীর্থণ নদীর ধারে একটি হোটেল দেখলাম নাম রেড-হাউস। দোতলায় ঘর পেলাম। বারান্দা থেকে একদম সামনে নদী। চারদিকে প্রচুর গাছ আর সারাক্ষণ পাখির ডাক লেগেই আছে, তার সাথে নদীর বয়ে চলার শব্দ। এখানে ঘর ভাড়া ১৫০০-২০০০ টাকা। খাওয়া আলাদা। আমাদের পৌঁছতে দুপুর ৩-টে বেজেছে। চণ্ডীগড় থেকে জিভির দূরত্ব প্রায় ২৭৩ কিমি। ফ্রেশ হয়ে একটু বাইরে হাঁটা চলা করে বারান্দায় কিছুক্ষণ নদীর ধারে বসে রইলাম। তারপর রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পরলাম।
জিভির দ্রষ্টব্য স্থান | Sightseeing in Jibhi Village , Himachal Pradesh
জিভির উচ্চতা ৬,০০০ ফুট মতো। হোটেল ছাড়াও বাইরে খাবার দোকান আছে দু-তিনটি ছোট। সকাল সকাল বেরোলাম জিভি ঝর্ণা দেখতে। কাছাকাছি গিয়ে দেখলাম গেট খোলেনি। তাই বাইরে আমরা একটা ছোট দোকানে চা-জলখাবার খেয়ে নিলাম, মোমো-স্যান্ডউইচ দিয়ে। ৮টার সময় ঝর্ণায় যাওয়ার দরজা খুলতে ২০ টাকা করে টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকলাম।গিয়েই দেখলাম বেশ কিছু পাখি ঘুরঘুর করছে আর ঝর্ণার জলে রামধনু খেলা করছে। দারুণ লাগলো। বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে হোটেলে এসে স্নান খাওয়া সেরে আবার হেঁটেই বেরিয়ে পরলাম এখানকার মিনি-থাইল্যান্ড দেখতে, গাড়িতেও যাওয়া যায় জিভি থেকে সোজা যাওয়ার পথের ওপরই এই জায়গাটা। এই রাস্তায় অনেক ফুল দেখলাম বেশিরভাগই ন্যাসপাতি আপেল গাছে ফুল হয়ে আছে।
জিভি থেকে সোজা'র পথে | Jibhi to Shoja Village , Himachal Pradesh
আবার হোটেলে এসে চেক-আউট করে বেরিয়ে পরলাম সোজার বাস ধরতে। জিভি থেকে সোজা একদম কাছে মাত্র ৭ কিমি। তাই আজ আমাদের কোনো তাড়া ছিলো না। কিন্তু সোজার বাস বেরিয়ে গেছে আগেই তাই আমরা একটা গাড়ি ভাড়া করলাম ট্যাক্সি ইউনিয়ন থেকে ভাড়া ৫০০ টাকা। এপথে বাস চলাচল করলেও একটা বাস চলে গেলে আর একটা আসতে অনেকটাই দেরি হয় তাই দাঁড়িয়ে না থেকে সুবিধামতো এগিয়ে যাওয়া। বাসের সময় জানা থাকলেও অনেক সময় আগেই বেরিয়ে যায় আবার বেশিরভাগ সময় দেরি করে। আজ সময়ের আগেই বেরিয়ে গেছে। জিভি থেকে জালোরি পাসের দিকে সোজা গ্রাম। অর্থাৎ সোজা গ্রাম জিভি আর জালোরি জটের মাঝখানে। সোজা থেকে মাত্র ৫ কিমি জালোরি পাস। তাই জিভি থেকে ৭ কিমি হলেও সোজার উচ্চতা কিন্তু প্রায় ৯০০০ ফুট। এই জালোরি পাসের উচ্চতা ১০,৫০০ ফুট। আমরা নদীর ধার থেকে ক্রমশঃ উঠে যাচ্ছি উপরে অর্থাৎ তীর্থণ ভ্যালি থেকে সেরাজ ভ্যালিতে প্রবেশ করছি।
সোজা গ্রাম, জালোরি জট সেরাজ ভ্যালির অন্তর্গত। জালোরি জট ছাড়িয়ে ওদিকে রামপুর, নারকান্দা হয়ে সিমলা চলে যাওয়া যায়। তবে শীতকালে বরফ পড়ে এপথ বন্ধ থাকে। তখন শুধু মান্ডি-অটের দিকের রাস্তাটাই খোলা থাকে। অনেকেই সিমলা থেকে শুরু করে নারকান্দা, রামপুর, জালোরি, সোজা, জিভি, বানজার,অট হয়ে মান্ডি, মানালি অথবা কাসোল চলে যান। বরফ পড়ে রাস্তা বন্ধের সময় ছাড়া এ পথে নিয়মিত বাস চলাচল করে। আর আমরা যেদিক দিয়ে এসেছি এদিকটা দিয়ে সারা বছরই আসা যায়। জিভির এতো কাছে হয়েও সোজার সৌন্দর্য্য একদম আলাদা। এখানে ঠান্ডা অনেক বেশি। তার ওপর বিকেল দিকে প্রায় রোজই হালকা বৃষ্টি হচ্ছে তাই ঠান্ডা আরো বাড়ছে। তবে সকাল হলেই পরিস্কার রোদ ঝলমলে আকাশ। এখানে আমরা সত্যম হোম'স এ ঘর নিলাম। ঘর ভাড়া ১৫০০ টাকা। সোজার রাস্তা থেকে জালোরি পাস ও ওখানকার মন্দিরটি দেখা যায়|
তীর্থন উপত্যকা, হিমাচল প্রদেশ ভ্রমণ -দ্বিতীয় পর্ব
মায়াময় মিয়ার উপত্যকা লাহুল, হিমাচলপ্রদেশ