জালোরি পাস
সকাল ৯-টার লোকাল বাস, এটি বানজারের দিক থেকে আসছে। এই বাসে করে আমরা সোজা থেকে জালোরি পাস যাচ্ছি। আজও আমাদের রাতের আশ্রয় সোজা'র সত্যম হোম'স। বাসে বসার জায়গা পেলাম না, বেশ ভিড়। দাঁড়িয়েই যাচ্ছি। গাড়ি ভাড়া করে গেলে ৫০০ টাকা লাগবে। বাসে করে জালোরির পথে যেতে পাহাড়ের গায়ে অনেক প্রিমূলা ফুল দেখলাম তার সাথে আরও একরকম বেগুনী ফুল। জায়গায় জায়গায় স্তুপাকারে ভালোই বরফ জমে আছে, তারমানে এদিকটা এখনো প্রায়ই তুষারপাত হয়ে চলেছে কখনো হালকা কখনো ভারি। সোজা থেকে বাসে জালোরি পাসের ভাড়া ১০ টাকা। পৌঁছতে সময় লাগলো ২০ মিনিট।
সিসু, লাহুল উপত্যকা হিমাচলপ্রদেশ ভ্রমণ
সেরোলসর লেক
জালোরি পাসে আসার উদ্দেশ্য সেরোলসর লেক। জালোরি পাস থেকে সেরোলসর লেক ৫ কিমি হেঁটে যেতে হয়। যাওয়া-আসা নিয়ে ১০ কিমি। অর্থাৎ সকালে বেরোলে আবার সোজা বা জিভি পৌঁছতে দুপুর গড়িয়ে যাবে। জালোরি পাস থেকে আরো একটি ট্রেক হয় রঘুপুর ফোর্ট। এটি ৩ কিমি হাঁটাপথ। কিন্তু দুটো একদিনে আমাদের হবে না, তাড়াহুড়ো করতে হবে তাই শুধু সেরোলসর লেকই যাবো ঠিক করি। পাহাড়ে ছোট ট্রেকপথ যেমন হয় হালকা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পুরো পথটাই। এখানেও রাস্তায় কোথাও কোথাও বরফ জমে আছে। পাহাড়ে ঘেরা একটি পবিত্র জলাশয় সেরোলসর লেক। একটু উপরে বুধি নাগিন মন্দির। এখানে মন্দির কমিটির গেস্ট হাউসে থাকাও যায়। কিছুক্ষণ এই লেকের ধারে, মন্দিরে ঘোরাঘুরি করে চা ম্যাগি মোমো খেতে খেতেই হালকা বরফ পড়তে শুরু করল। আমরা ফেরার পথ ধরলাম। ফেরার সময় হাঁটা পথের পুরোটাই হালকা তুষারপাত চলতেই থাকলো। আমাদের কোনো অসুবিধা হচ্ছে না বলে বেশ উপভোগ্যই লাগছে। তবে চিন্তাও হচ্ছে যদি হঠাৎ করে বেশি বরফ পড়তে শুরু করে তখন সমস্যা হবে। জালোরি পাসে পৌঁছে শুনলাম শেষ বাস বেরিয়ে গেছে বিকেল ৪-টে নাগাদ। তাই ৫০০ টাকা দিয়ে গাড়ি ভাড়া করে সোজা পৌঁছলাম।
আরও একরাত সোজা'তে
হালকা বৃষ্টি শুরু হয়েছে, এরকম রোজই হচ্ছে বিকেল দিকে। বেশ ঠান্ডা হাওয়ার দাপট। সত্যম হোমসের লাগোয়া অতিথি গেস্ট হাউসের রেস্টুরেন্টে চা আর হালকা খাবার খেতে খেতে বৃষ্টি-বিধৌত পাহাড়ের রূপ, মেঘলা আকাশের মধ্যে দিয়ে সূর্যাস্তের রঙের ছটায় মুগ্ধ হলাম। অতিথি গেস্ট হাউসেও থাকার জায়গা আছে। অতিথি গেস্ট হাউসের যিনি মালিক, সত্যম হাউসেরও মালিক (owner) উনিই কিন্তু এখন লিজে দিয়ে রেখেছেন। সোজাতে আরো কয়েকটি থাকার জায়গা আছে, সোজা এমনিতে ছোট জায়গা। সেই তুলনায় জিভিতে থাকার জায়গা অনেক বেশি।
সোজা থেকে বানজার
এখানে রুটের বাসে বেশ ভিড় হয়। তাই ভাবছিলাম বেলা ১১-টায় যে বাসটা বানজার যাওয়ার জন্য আসবে, জায়গা পাবো কিনা। একটু ভুল হয়ে গেছে। সকাল ৮-টার বাসে চলে গেলে ভালো হত, বেশ ফাঁকা থাকে এই বাসটা। যাইহোক ১১ টার বাসেও জায়গা পেলাম। আবার জিভি হয়ে বানজার। জিভির আগে ঘিয়াগির কাছে বেশ কিছুক্ষণ জ্যামে আটকে রইলাম। এখানে সরু রাস্তায় মুখোমুখি দুটো বড়ো বাস এসে গেলে পাস দিতে খুব অসুবিধা হয়। সেই কারণে জ্যাম হয়ে যাচ্ছে। ঘিয়াগিতেও হোমস্টে আছে। শৃঙ্গঋষি, চেহনি কোঠির রাস্তা ছাড়িয়ে বানজার পৌঁছে গেলাম। তাও ২ ঘন্টা লাগলো পৌঁছতে।
বানজার থেকে গুসাইনি
বানজার বাসস্ট্যান্ড থেকে গুসাইনি যাওয়ার বাস পেয়ে গেলাম সঙ্গে সঙ্গেই। সকাল ৭-টা থেকে বিকেল ৫-টা অবধি গুসাইনি যাওয়ার বাস পাওয়া যায় বানজার থেকে। বানজার থেকে লারজি হয়ে গুসাইনির দূরত্ব ১০ কিমি। জিভি-বানজার-গুসাইনি এই সবটা জুড়েই তীর্থণ উপত্যকা। অনেক হোটেল, রিসোর্ট, হোমস্টে নদীর ধার ঘেঁষে। লারজি একটি ছোট জনপদ। এখানে একটি পেট্রল-পাম্প আছে। লারজি থেকে ছোট ব্রীজ পেরিয়ে গুসাইনির রাস্তা। আবার ব্রীজের আগেই একটা সোজা রাস্তা উঠে গেছে এটা সাইঞ্জ উপত্যকা যাওয়ার রাস্তা। এই পথে আবার আগামীকাল যাবো সানগড়। অর্থ্যাৎ লারজি থেকে তীর্থণ উপত্যকা আর সাইঞ্জ উপত্যকার রাস্তা পৃথক হয়েছে। বানজার আর গুসাইনির ঠিক মাঝখানে সাই রোপা থেকে ছই জলপ্রপাত যাওয়ার হাঁটা রাস্তা চলে গেছে। নদীর ধার ধরে পর পর সুন্দর সাজানো থাকার জায়গাগুলি দেখতে দেখতে বাস আমাদের গুসাইনি বাজারের কাছে নামিয়ে দিয়ে এগিয়ে গেল।
রক এন্ড রিভার
আমরা আর একটু পিছিয়ে গিয়ে নদীর ধারেই একটা কাঠের বাড়ি দেখলাম। এক দিদির সাথে দেখা। উনি বললেন এটা ওনাদেরই গেস্ট-হাউস, ভাড়া ২০০০ টাকা। দোতলা কাঠের তৈরি বাড়িটির নীচের দুটি ঘরই আমাদের। কারণ টয়লেট একটি। স্যুট টাইপের যেমন হয়। আর দোতলায় দুটি ঘর আছে ব্যস। বেশিদিন হয়নি এই গেস্ট হাউসটি হয়েছে। পাশেই এইরকম আরও একটি কাঠের বাড়ি একটু পুরোনো, এটা আগে থেকেই আছে। এখানে লং টার্ম পেয়িং গেস্ট হিসেবে ভাড়া দেওয়া হয় যারা একটু বেশিদিনের জন্য থাকেন। পাশেই একটি ব্যাংকও আছে। ব্যাংকের জায়গাটাও দিদিদেরই, ভাড়া দিয়েছেন ব্যাংককে। থাকার জায়গাটির নাম রক এন্ড রিভার। খুবই সুন্দর। একেবারে প্রকৃতির কোলে থাকা যাকে বলে। এখানে থাকলে কিছুটা টেন্ট- এ থাকার আনন্দ পাওয়া যায় আবার বাড়িতে থাকার সুবিধা উপভোগ করা যায়। দুই দিদির রান্নাও দুর্দান্ত! গুসাইনি সত্যিই খুব সুন্দর আর উচ্চতা বেশি নয় বলে খুব আরামদায়ক আবহাওয়া। গুসাইনির উচ্চতা প্রায় ৫০০০ ফুট। অট থেকে দূরত্ব মাত্র ৩৭ কিমি। গুসাইনির পথে পথে ঘুরে বেরিয়ে দু-দিন অনায়াসে কেটে যাবে। গুসাইনি থেকে গ্রেট হিমালয়ান ন্যাশনাল পার্ক ট্রেকটিও হয়।
তীর্থন উপত্যকা, হিমাচল প্রদেশ কখন যাবেন
মান্ডির দিক দিয়ে গেলে সারাবছরই জিভি, সোজা, গুসাইনি যাওয়া যায়। বিভিন্ন ঋতুতে বিভিন্ন সৌন্দর্য্য ধরা দেয়, পাহাড়ে যেমন হয়। তবে শীতকালে জালোরি পাসের রাস্তা বরফের জন্য বন্ধ থাকে। তখন সিমলার দিক দিয়ে এদিকে আসা যায় না।
তীর্থন উপত্যকা, হিমাচল প্রদেশ কিভাবে যাবেন
নিকটতম রেলস্টেশন কালকা, চন্ডীগড়। আর নিকটতম বিমানবন্দর ভুন্টার, চন্ডীগড় । ট্রেনে বা প্লেনে চন্ডীগড় পৌঁছে মান্ডি-অট হয়ে তীর্থণ ভ্যালি পৌঁছনো যায়।যেকোন ট্রেনে বা প্লেনে দিল্লী পৌঁছেও বাসে বা গাড়ি ভাড়া করে ঘুরে নেওয়া যায়।
আমাদের রুট ছিল
- প্রথম দিন : চন্ডীগড় থেকে জিভি প্রায় ২৭৩ কিমি।
- দ্বিতীয় দিন : জিভি থেকে সোজা ৭ কিমি।
- তৃতীয় দিন : সোজা থেকে জালোরি পাস ৫ কিমি। জালোরি পাস থেকে সেরোলসর লেক ৫ কিমি হাঁটা পথ। আবার সোজা পৌঁছে রাতের আশ্রয়।
- চতুর্থ দিন : সোজা থেকে গুসাইনি প্রায় ৫২ কিমি।
- পঞ্চম ও ষষ্ঠ দিন : গুসাইনি থেকে সানগড় (সাইঞ্জ উপত্যকা ) প্রায় ৭২ কিমি।
- সপ্তম দিন : সানগড় থেকে কাসোল (পার্বতী উপত্যকা ) প্রায় ৮৮ কিমি।
আমরা এই রুটটা প্রায় পুরোটাই HRTC র বাসে ঘুরেছি। খুব প্রয়োজনে গাড়ি ভাড়া করেছি। তবে বাসে ঘুরলে লাগেজ কম থাকতে হবে, রুটের বাসে লাগেজ রাখার আলাদা জায়গা নেই। বাসে ভিড় হয়। বাসে ঘোরা সময় সাপেক্ষ।
গাড়ি ভাড়া করলে জ্ঞান জির সাথে যোগাযোগ করতে পারেন। ইনি এদিকে বেশ অভিজ্ঞ আর অত্যন্ত ভদ্র, নম্র, শিক্ষিত একজন মানুষ বলে আমার মনে হয়েছে।
জ্ঞান ধামী (Gyan Dhami )
Ph no : 7807413913
থাকার জায়গা :- জিভিতে আমরা ছিলাম রেড হাউস ক্যাফে এন্ড ইন (Red House Cafe & Inn)
Ph no :- 98053-01902
রেড হাউসের পাশেই আছে লাটোডা হাট এন্ড চৌহান'স প্যালেস ( Lato The Hut & Chauhan's Palace.)।
এছাড়া দামী থেকে কমদামী সবধরণের থাকার ব্যবস্থা রয়েছে জিভিতে। জিভি থেকে ২-৩ কিমি ওপরে তান্ডিতে ট্রি-হাউসে থাকার সুব্যবস্থাও আছে। জিভি থেকে ১ কিমি দূরে ভালাগ্রাণ গ্রামে আছে লাটোডা ইকো লজ (Lato The Eco Lodge)। বাহু গ্রামে আছে ঈশান ইকো লজ (Ishan Eco Lodge)।
সোজা গ্রামে আমরা ছিলাম সত্যম হোমস্টেতে (Satyam Home Stay)
Phone no :- 75032-73879
এছাড়াও সোজাতে থাকার জন্য বাজেট হোটেল অতিথি গেস্ট হাউস ছাড়াও বানজার রিট্রিট-এর মতো ২-৩ টি খরচসাপেক্ষ হোটেল ও আছে। তবে সোজাতে জিভির তুলনায় থাকার জায়গা অনেক কম।
গুসাইনির ২ কিমি আগে থেকেই নদীর ধার ঘেঁষে পর পর অনেক হোটেল রিসোর্ট হোমস্টে শুরু হয়েছে।
গুসাইনিতে রাজু'স্ কান্ট্রি কটেজ (Raju's Country Cottage ) খুবই নামকরা হোমস্টে। এখানে যেতে হলে নদী পেরিয়ে ওপারে যেতে হবে। আগে ট্রলি করে নদী পারাপার হতো এখন সরু কাঠের সাঁকো তৈরি হয়েছে। এখানে থাকা-খাওয়ার খরচা জনপ্রতি ১৭০০ টাকা মতো।
এছাড়াও ছড়িয়ে আছে আরো হোটেল। গুসাইনিতে আমরা ছিলাম রক এন্ড রিভার-এ একেবারে প্রকৃতির কোল ঘেঁষে।
Rock & River Home Stay
Ph no: 08628942923/ 09418777247
তীর্থন উপত্যকা, হিমাচল প্রদেশ ভ্রমণ -প্রথম পর্বl