বনধ আর বৃষ্টিকে সঙ্গী করে সিটং অহলদারার পথে
এবার নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে নেমেই বৃষ্টি। ফুড-কোর্টে জলখাবার খেতে খেতে শুনলাম বেলা বাড়লে শিলিগুড়ির দিকে বনধ-অবরোধ হওয়ার সম্ভাবনা। তাই তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়তে হবে। স্টেশন থেকে বেরিয়ে একটু খোঁজার পর একটা জীপের পেছনের সিটে জায়গা হল। সবাই দার্জিলিং যাবে। কিন্তু আমাদের বললো মংপু নামিয়ে দেবে, ভাড়া ৫০০ টাকা করে।
এবার আমাদের গন্তব্য সিটং অহলদারার দিকে। ভেবেছিলাম কার্শিয়াং অবধি শেয়ার গাড়িতে গিয়ে, এরপর গাড়ি ভাড়া করে নেবো। কিন্তু কার্শিয়াং-এর গাড়ি পেলাম না। অন্য সময় হলে শিলিগুড়ি চলে যেতাম। শিলিগুড়ি থেকে শেয়ার গাড়ি, বাসের সুবিধা বেশি। কিন্তু এবার বৃষ্টি বনধ সব মিলিয়ে আর গেলাম না। আমরা ছাড়া বাকি সবাই দার্জিলিং -এর প্যাসেঞ্জার।
চটকপুর ভ্রমণ কাহিনী, অফবিট দার্জিলিং উত্তরবঙ্গ
আমাদের জন্য গাড়ি মংপু দিয়ে ঘুরিয়ে নিয়ে যাবে তাতে কারোর কোন সমস্যা দেখলাম না। বেশ অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর গাড়ি ভর্তি হতে, গাড়ি ছাড়লো। সেই ভিজে পাহাড়ি রাস্তা, তিস্তার বুকে কুয়াশা দেখতে দেখতে কেমন নেশা লেগে যায় যতবারই যাই এ পথে। বর্ষার রূপ, মাধুর্য অন্যরকম। আবার বর্ষার একটা আলাদা গন্ধ আছে।
$ads={1}
{tocify} $title={Table of Contents}
শিলিগুড়ি থেকে মংপুর পথে
মাঝে নিয়মমতো গাড়ি দাঁড়ালো খাবারের জন্য। এরপর ড্রাইভার দাদা বলে নাকি রাস্তায় দাঁড়িয়ে মংপুর গাড়ির জন্য অপেক্ষা করতে! আমরা তো নামলাম না। এই নিয়ে একটু ঝামেলা। এরপর বুঝলাম উনি মংপুর দিকের অহলদারার রাস্তা চেনেন না নাকি যেতে চাইছিলেন না বলে বেশ ঘোরাঘুরির পর ঠিক পথ ধরেছেন। একদম পাহাড়ের ভেতরের রাস্তা যেমন হয় তেমন -- বারে বারে হেয়ার পিন বেন্ড পেরিয়ে আর দুদিকে ঘন সবুজ, তার ওপর হালকা মেঘের আস্তরণে ঢাকা পথ। আহা!
মংপু থেকে সিটং অহলদারা
বেশ বেলা হয়ে গেল মংপু পৌঁছতে। যারা দার্জিলিং বেড়াতে যাচ্ছেন তাদের হেলদোল নেই। ওদের তিনজনের বেশ মজা নতুন রাস্তা, জায়গা দেখতে দেখতে যাচ্ছে। বলছে "সাইড সিইং হয়ে যাচ্ছে "! আর বাকি তিনজন কাজে যাচ্ছেন, ওরা একটু বিরক্ত। সেটাই স্বাভাবিক। আমরা বৃষ্টির মধ্যে মংপুতে নেমে সঙ্গে সঙ্গেই গাড়ি ভাড়া করে সিটং এর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। ভাড়া ১৫০০ টাকা।
নিউ জলপাইগুড়ি থেকেও সিটং ৩,০০০-৩,৫০০ টাকায় ছোট গাড়ি পাওয়া যায় কিন্তু আমরা পাই নি ওই ঝামেলার জন্য আর তাড়াও ছিল। টানা গেলে তাড়াতাড়ি পৌঁছেও যাওয়া যায়, দু-আড়াই ঘন্টায়। দূরত্ব প্রায় ৫৫ কিমি। আমাদের মংপু পৌঁছতেই ৩ ঘন্টা লাগলো-- খাবারের বিরতি, ঘোরাঘুরি, ঝামেলা সব ধরে। এরপর রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি-বিজড়িত বাড়ি দেখে, যোগীঘাট ব্রীজ পেরিয়ে বেশ তাড়াতাড়িই পৌঁছে গেলাম সিটং।
অহলদারা ভিউ পয়েন্ট
মংপু থেকে সিটং ১১ কিমি। মানে সিটং শুরু। সিটং- ১, ২, ৩ মিলিয়ে সিটং আসলে অনেকটা জায়গা জুড়ে। সারা সিটং জুড়ে প্রায় ২০০ হোমস্টে। ড্রাইভার দাদা বললেন অহলদারাতে গিয়ে থাকতে। তাই আরো এগিয়ে গেলাম।
সিটং -এর মধ্যেই অহলদারা একটা ভিউ পয়েন্ট। অহলদারা উচ্চতা ৫০০০ ফুট আর সিটং ৪০০০ ফুট। অহলদারাতে থাকার জায়গা কম। বেশিরভাগ মানুষ সিটং এ থেকে অহলদারা ভিউ পয়েন্ট ঘুরে যান।
পরিস্কার আকাশে এখান থেকে ৩৬০ ডিগ্রি জুড়ে ঢেউ খেলানো পাহাড়ের সারি, দূরে কাঞ্চনজঙ্ঘা দৃশ্যমান। একদিকে যেমন ডুয়ার্স, অন্যদিকে মংপু, দার্জিলিং, কালিম্পং, সিকিমের পাহাড়, চা বাগান, নদীর বয়ে চলা দৃশ্যমান।
একেবারে নির্জন জায়গা বলে রাতেরবেলাও দূর পাহাড়ের আলো ঝলমলে দৃশ্য দেখার মতোই। তবে সবটাই আবহাওয়ার ওপর নির্ভর করে। মেঘলা দিনেও পাইনের সারি, সিঙ্কোনা গাছের চাষ, পাখির কূজন, প্রজাপতির উড়ে বেড়ানো, ফুলে সাজানো বাড়িঘরগুলি মন ভরিয়ে দেবে।
অহলদারার হোমস্টে
কার্শিয়াং, মংপু ছাড়াও কালিঝোরার দিক দিয়ে লাটপাঞ্চার হয়েও ঢোকা যায় অহলদাঁড়া-সিটং। অহলদাঁড়া, সিটং, লাটপাঞ্চার সবই ৪-৫ কিমি দূরত্বে অবস্থিত, সেলপু পাহাড়ের অন্তর্গত। লোয়ার, মিডল, আপার সিটংয়ের সুন্দর হোমস্টেগুলি দেখতে দেখতে নামথিং পোখরিকে পাশ কাটিয়ে উঠে এলাম অহলদারা ভিউ পয়েন্ট।
একটু নীচে নেমে সানরাইজ ভিউপয়ন্ট হোমস্টেটে ঘর পেলাম না, আবার উপরে উঠে পদম গুরুংজির ৩৬০ ডিগ্রি প্যানোরামা ভিউ পয়েন্টে জায়গা পেলাম। এখানে আবার ৫ টা কটেজই খালি। আমাদের ৩ জনের থাকা-খাওয়া সব মিলিয়ে একদিনে ১২০০ টাকা করে প্রত্যেকের।
ড্রাইভার দাদার নাম নগেন লেপচা। বেশ ভালো মানুষ। আমরা এনাকেই বললাম ফেরার সময় আমাদের দার্জিলিং নিয়ে যেতে। অহলদাঁড়া থেকে ভাড়া ৩,৫০০ টাকা। ওনাকে তো মংপু থেকে আসতেও হবে।
সমানে বৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে থামছে। আমরা একটু হাঁটতে বেরোচ্ছি মেঘ-কুয়াশার মধ্যে। চারদিক ঢাকা। এখানে আরো কিছু হোমস্টে আছে। নামথিং পোখরি এখান থেকে হাঁটা দূরত্বে। নামথিং পোখরির কাছেও হোমস্টে আছে।
পদম গুরুংজির সঙ্গেও আলাপ হলো, বেশ ভালো মানুষ। আর হোমস্টের ছেলেটিও বেশ হাসিখুশি। হররর করে যে কত কথা বলছে কোন রাখ ঢাক নেই। ওর গার্লফ্রেন্ড আবার দুবাইতে বিউটি পার্লারে কাজ করতে গেছে। পদম গুরুংজির আর ওনার স্ত্রীর খুব প্রশংসা করছে। খুবই হেল্পফুল ওনারা সেইসব কথা। ওর মা সারাক্ষণ ফোনে ব্যস্ত। দুই ভাই মিলে ৩০,০০০ টাকার ফোন কিনে দিয়েছে। আর এক ভাই অহলদাঁড়া ভিউ পয়েন্টে মোমোর দোকান দেয়। অস্থায়ী ছাউনি। মোমো, চা, ম্যাগি পাওয়া যায়। এখানে আমরা বেশ ভালো স্কোয়াশের মোমো খেলাম।
সন্ধ্যা থেকে বৃষ্টি বেড়েই চলেছে। সারারাত ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। আওয়াজে খালি ঘুম ভেঙে যায়। একবার একটু বেগ থামে আবার শুরু হয়। অদ্ভুত অনুভূতি!
বনধ আর বৃষ্টি মাথায় সিটং অহলদারা থেকে দার্জিলিং
ভেবেছিলাম আজ অর্থাৎ দ্বিতীয় দিন সিটং বা লাটপাঞ্চারে থাকবো। তারপর শুনলাম আগামীকাল দার্জিলিং বনধ। এবার এই বনধ আর বৃষ্টি শুরু থেকেই সঙ্গী। এবছর উত্তরবঙ্গে এত বৃষ্টি কিন্তু দক্ষিণবঙ্গ পুরুলিয়ার দিকে বৃষ্টিই নেই। এখন বৃষ্টি হবে জেনেই আসা। সময়টা অগস্টের শেষ সপ্তাহ। তবে এমন একনাগাড়ে বৃষ্টি হয়ে যাবে তাও ভাবিনি। নগেনজিকে ডেকে নিলাম দার্জিলিং যাওয়ার জন্য। গতকাল বিকেলে পদমজি এসেছিলেন আবার আজ এলেন দুধ, খাবারের সরঞ্জাম পৌঁছতে। ১০ টা নাগাদ আমরা জলখাবার সেরে রেডি। নগেনজিও চলে এসেছেন। গতকাল রাতে হোমস্টেতে দেশী চিকেন, ডাল, আলুভাজা খাইয়েছিল। আজ জলখাবারে পরোটা, আলু চচ্চড়ি।
নামথিং পোখরি গতকাল থেকেই ঘন কুয়াশার চাদরে ঢাকা। এই পোখরিতেই লুপ্তপ্রায় প্রাণী হিমালয়ান স্যালাম্যান্ডরের বাস। এই নামথিং পোখরিতে কেবল মাত্র বর্ষাকালেই জল থাকে। বাকি সময়ে জল থাকে না। তাই বর্ষাকালই সেরা সময় স্যালাম্যান্ডর দেখার জন্য। একে হিডেন লেক বলা হয়ে থাকে। কারণ ধুপি, পাইন গাছ দিয়ে ঘেরা এমন একটা জায়গায় এই লেকটি রয়েছে সেটা বলে না দিলে বোঝাই যাবে না! ঝিরঝির করে বৃষ্টি হয়েই যাচ্ছে, পোখরিতে জলও অনেক কিন্তু ঘন কুয়াশার জন্য স্যালাম্যান্ডরও দেখতে পেলাম না। তবে জায়গাটা ভারি সুন্দর। এবার আমরা কার্শিয়াং-এর পথ ধরলামা। ছোট ছোট পাহাড়ী গ্রামের মধ্যে দিয়ে গিয়ে সোনাদা ঘুম পেরিয়ে দার্জিলিং পৌঁছে গেলাম বেশ তাড়াতাড়ি।
কখন যাবেন সিটং অহলদারা
নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি কমলালেবুর সময় সিটং, অহলদাঁড়া যাওয়ার আদর্শ সময়। এছাড়া সারা বছর যাওয়া যায়।
সিটং অহলদারা কিভাবে যাবেন
নিউ জলপাইগুড়ি বা শিলিগুড়ি থেকে অহলদাঁড়া যাওয়া যায় বেশ কয়েকটি পথে ---- কার্শিয়াং হয়ে, মংপু হয়ে, কালিঝোরা হয়ে। বিভিন্ন দিক থেকে দূরত্ব কিছুটা কম বেশি হয়। ছোট গাড়ি ভাড়া ৩,০০০-৩,৫০০ টাকা। বড়ো গাড়ি ৪,০০০-৪,৫০০টাকা। আমরা মংপু অবধি শেয়ারে গিয়ে মংপু থেকে গাড়ি ভাড়া করেছি। এদিক দিয়ে দূরত্ব একটু বেশি পরে।
নগেন লেপচা ফোন নং :-
9294824713
কোথায় থাকবেন সিটং অহলদারায়
সারা সিটং জুড়ে অনেক থাকার জায়গা। অতিথি হোমস্টে, বিশেষ হোমস্টে, রিষান কটেজ, পাইন ট্রি হোমস্টে, মেঘবিতান রিসর্ট, অরেঞ্জ ট্রি হোমস্টে ইত্যাদি।
কমল হোমস্টে
ফোন নং : 9339012005/ 9547237332
সুজাতা হোমস্টে
ফোন নং : 9891524856
টি গার্ডেন হোমস্টে
ফোন নং : 9891524856
অহলদাঁড়া যেহেতু সিটং এর মধ্যেই একটি ছোট জায়গা তথা ভিউ পয়েন্ট, অহলদাঁড়াতে থাকার জায়গা কম।
ভিউ পয়েন্টে মাত্র দুটি হোমস্টে আছে।
চামলিং হোমস্টে বা সানরাইজ হোমস্টে
ফোন নং :- 8759746797
৩৬০ ডিগ্রী প্যানোরামা ভিউ পয়েন্ট বা গুরুং হোমস্টে
ফোন নং :- 9064134198
এছাড়াও নামথিং পোখরির কাছে ও গ্রামে আরো কয়েকটি হোমস্টে আছে।
সিটং অহলদারা থেকে আনুমানিক দূরত্ব :
- নামথিং পোখরি ১ কিমি এর মধ্যে
- আপার সিটং ৩ কিমি
- লোয়ার সিটং ১০ কিমি
- লাটপাঞ্চার ৪ কিমি
- কালিঝোরা ১৮ কিমি
- মংপু ২১ কিমি
- কার্শিয়াং ৩৪ কিমি
- দার্জিলিং ৫১ কিমি
- কালিম্পং ৫০ কিমি
- শিলিগুড়ি ৪৭ কিমি